রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাময়িকভাবে রপ্তানি ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে সাভারে চামড়াশিল্প নগরে উৎপাদন শুরু হলে তা শিল্পের জন্য লাভজনক হবে। কারণ, চামড়া উৎপাদনে পরিবেশদূষণ না হলে ইউরোপ ও আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা শুরু করতে পারে বলে মনে করছেন দেশের ট্যানারি মালিক ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকেরা।
ট্যানারি মালিক ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকেরা বলছেন, বাংলাদেশি চামড়ার মান ভালো হলেও বড় বড় ব্র্যান্ডের কাছে তার কদর কম। বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে ২০১৪ সাল থেকে চামড়া নেওয়া বন্ধ রেখেছে। এর বদলে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিকারকেরা যেসব বড় ব্র্যান্ডের পণ্য উৎপাদন করে, তা মূলত আমদানি করা চামড়ায়। পরিবেশদূষণের কারণেই মূলত বড় ক্রেতারা হাজারীবাগের চামড়ার ওপর একধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রেখেছে। তবে বাংলাদেশি চামড়া চীন, কোরিয়া ও ইতালি যাচ্ছে। সেখান থেকে পণ্য তৈরি হয়ে তা আবার যায় ইউরোপ ও আমেরিকায়। অবশ্য সেখানে বাংলাদেশের কোনো নাম-পরিচয় থাকে না।
জানা গেছে, ১৯৫১ সালে রাজধানীর হাজারীবাগে যে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের যাত্রা শুরু হয়, ছয় দশক পরেও তাতে পরিবেশ সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। হাজারীবাগের ২০৫টি ট্যানারি প্রতিদিন প্রায় ২১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলত। এ ছাড়া বিভিন্ন শক্ত বর্জ্য বেড়িবাঁধের পাশে, খালে, জলাধারে ও রাস্তার পাশে ফেলতেন মালিকেরা। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক পরিবেশবাদী সংস্থা পিওর আর্থ ২০১৩ সালে বিশ্বের ১০টি এলাকাকে সর্বোচ্চ দূষিত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে, তার মধ্যে একটি ছিল হাজারীবাগ। উচ্চ আদালতের নির্দেশে পরিবেশ অধিদপ্তর ৮ এপ্রিল হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোর সেবা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এখন সাভারে প্রতিষ্ঠিত চামড়াশিল্প নগরে উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় আছেন ট্যানারি মালিকেরা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদারগুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বখ্যাত বড় ব্র্যান্ড ও ক্রেতারা পরিবেশ ও অন্যান্য মান নিয়ে খুব সচেতন। পরিবেশসম্মতভাবে উৎপাদন শুরু হলে বাংলাদেশ থেকে চামড়া নিতে তাদের নীতিগত কোনো বাধা থাকবে না। তারা সরাসরি বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনলে দাম কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বেশি পাওয়া যাবে।
এ ক্ষেত্রে প্রথমেই পরিবেশ সুরক্ষায় বিশেষ জোর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, পরিবেশের পাশাপাশি শ্রমের মান, কারখানার কাঠামোগত বিষয় ও ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার না করার বিষয়েও নজর দিতে হবে।
তৈরি পোশাকের পর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রপ্তানি আয় হয় বাংলাদেশের। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জন্য চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১২২ কোটি মার্কিন ডলার বা ৯ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা (এক ডলার সমান ৮০ টাকা ধরে)। এর মধ্যে গত ৯ (জুলাই-মার্চ) মাসে ৯২ কোটি ২৯ লাখ ডলার আয় হয়েছে। এই আয় গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি।
সর্বশেষ ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১১৬ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এর মধ্যে চামড়া ২৭ কোটি ৭৯ লাখ ডলার, চামড়াজাত পণ্য ৩৮ কোটি ৮২ লাখ ডলার এবং চামড়ার জুতা থেকে আয় হয়েছে ৪৯ কোটি ৪৮ লাখ ডলার। গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১১৩ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছিল।
চামড়াশিল্পের শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর প্রথম আলোকে বলেন, বড় ব্র্যান্ডের পণ্য তৈরিতে আমদানি করা চামড়া ব্যবহার করে হাতে গোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। তবে সাভারে পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে ট্যানারিগুলো চালু হলে আমদানি না করে দেশীয় চামড়াই ব্যবহার করা যাবে। এ জন্য অবশ্যই বর্জ্য পরিশোধনাগার দিয়ে ক্রেতাদের সন্তুষ্ট করতে হবে।
অবশ্য হাজারীবাগের চামড়া দিয়ে পণ্য তৈরি করে রপ্তানি হয়। আবার সরাসরি চামড়াও রপ্তানি হয় বিভিন্ন দেশে। এমন তথ্য দিয়ে নাসিম মঞ্জুর বলেন, হাজারীবাগে গ্যাস-বিদ্যুতের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এটি এড়াতে সরকারকে সাভারে যত দ্রুত সম্ভব গ্যাস-সংযোগসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে।
সাভারে ১৯৯ একর জমিতে প্রতিষ্ঠিত চামড়াশিল্প নগরে ৪৮টি ট্যানারি ওয়েট ব্লু চামড়া উৎপাদন শুরু করেছে। পাঁচটি ট্যানারি গ্যাস-সংযোগ পেয়েছে। ট্যানারি মালিকেরা চাচ্ছেন সেখানে দ্রুত গ্যাস ও অন্যান্য সেবা, যাতে উৎপাদন শুরু করা যায়। কিন্তু অধিকাংশ ট্যানারি উৎপাদনের পর্যাপ্ত প্রস্তুতি এখন পর্যন্ত শেষ করতে পারেনি।
ফরচুন লেদার ক্র্যাফটসের চেয়ারম্যান আবু তাহের বলেন, গ্যাস-সংযোগ দিলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সাভারে প্রস্তুতি সম্পন্ন করা যাবে। তাই শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হলে হাজারীবাগে ট্যানারি বন্ধে তেমন একটা সমস্যা হবে না। উল্টো সামগ্রিকভাবে দেশই লাভবান হবে। সবকিছু আগামী কোরবানির মধ্যে হলে ভালো হয়।
আবু তাহের আরও বলেন, পরিবেশগত কারণে হাজারীবাগের চামড়ার দাম কম দেন ক্রেতারা। তাই সাভারে পরিকল্পিত চামড়াশিল্প নগরীতে উৎপাদন পুরোপুরি শেষ হলে অবশ্যই চামড়ার দাম বেড়ে যাবে।