বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকারের বিষয়টি নিয়ে যখন আলোচনা হয়, তখন একমাত্র তৈরি পোশাক খাত গুরুত্ব পায়।
এ খাতটি সব মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। অন্য শিল্পখাতের শ্রমিকদের অধিকার কিংবা নিরাপত্তার বিষয়টি ততটা আলোচিত হয় না। এর কারণও আছে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে গার্মেন্ট কারখানাগুলোতে অগি্নকা- এবং নানা ধরনের দুর্ঘটনায় যত শ্রমিক নিহত হয়েছে, সেটি অন্য কোনো শিল্পখাতে হয়নি।
২০১৩ সালে সাভারে রানা প্লাজা ধসে পড়ে প্রায় সাড়ে ১১শ শ্রমিক মারা যায়। পঙ্গু হয়েছে আরও অনেকে। সে দুর্ঘটনা বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্পে শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টিকে বিশ্বের সামনে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল।
এরপর গার্মেন্ট খাত নিরাপদ করার ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তৈরি পোশাক খাতের বাইরে অন্য খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি ততটা আলোচনায় আসে না। এত বড় একটি দুর্ঘটনার পর সার্বিকভাবে বাংলাদেশের শিল্পখাতে শ্রমিকদের নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত হয়েছে? অনেকে এখন এ প্রশ্ন তুলছেন।
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন বিলসের সুলতান উদ্দিন আহমেদ মনে করেন, গত চার বছরে গার্মেন্ট খাত নিরাপদ করার যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তার মূলে রয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যকে নিরাপদ করা।
আহমেদ মনে করেন, যেহেতু গার্মেন্ট খাত সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে, সেজন্য ক্রেতাদের চাপে পড়ে মালিক এবং সরকার সেদিকে বেশি নজর দিয়েছে। অন্য খাতগুলো যেহেতু গার্মেন্টের মতো বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে না, সেজন্য সেসব খাতের শ্রমিকদের নিরাপত্তার দিকে নজর কম।
আহমেদ বলেন, ‘কেউই মনে করছে না যে তার কাজের পরিবেশ নিরাপদ করা দরকার। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মনে না করবে যে তাদের অবহেলা এবং অবজ্ঞার কারণে কোনো প্রাণহানি হলে মালিককে শাস্তি এবং ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিন্তু এটা হবে না।’
রানা প্লাজা ধসের পর গত চার বছরে ইউরোপ এবং আমেরিকার ক্রেতাদের উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকার মিলে গার্মেন্ট কারখানা নিরাপদ করার উদ্যোগ নেয়। এর আওতায় প্রায় চার হাজার গার্মেন্ট কারখানা পরিদর্শন করা হয়। শ্রম মন্ত্রণালয় বলছে, পরিদর্শনের পর ৪২টি কারখানা সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়েছে এবং প্রায় ২০০টির মতো কারখানায় ব্যাপক সংস্কার করতে হয়েছে।
গত চার বছরে গার্মেন্ট শিল্পে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না হলেও অন্যান্য শিল্পখাতে প্রাণহানি থেমে নেই। গত বছর টঙ্গিতে টাম্পাকো নামের একটি প্যাকেজিং কারখানায় প্রায় ৪০জন শ্রমিক নিহত হয়। বিভিন্ন সময় চাতাল এবং জাহাজ শিল্পখাতে দুর্ঘটনায় শ্রমিক মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।
নিটওয়্যার রপ্তানিকারক ফজলুল হক মনে করেন, বর্তমানে অন্য অনেক শিল্পখাতের তুলনায় গার্মেন্ট শিল্প অনেক নিরাপদ।
হক বলেন, ‘অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রি যেগুলো আছে সেগুলো কোনো ফোকাসে নেই। যত আলোচনা সব গার্মেন্ট শিল্প নিয়ে। গার্মেন্ট শিল্পের বাইরে অনেক কারখানা আছে যেগুলোতে নিরাপত্তার খুবই ভঙ্গুর।’
শিল্প কারখানায় নিরাপত্তা তদারকির দায়িত্ব শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা পরিদর্শন সংস্থার। কিন্তু রানা প্লাজা ধসের আগে কলকারখানা পরিদর্শক ছিল হাতেগোনা। গত চার বছরে দেড় শ পরিদর্শক নিয়োগ করা হয়েছে।
আগামী এক বছরের মধ্যে আরও ২০০ পরিদর্শক নিয়োগ করা হবে বলে জানিয়েছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক।
শ্রম প্রতিমন্ত্রী জানালেন গার্মেন্ট খাত থেকে যেহেতু সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আসে এবং এককভাবে এ খাতে সবচেয়ে বেশি শ্রমিক কাজ করে, সেজন্য এ খাত সবচেয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে।
‘আমরা একটা কর্মপরিকল্পনা করেছি। গার্মেন্টের পর আমরা এখন যেসব কারখানা বিস্ফোরক বা কেমিকেলজাতীয় সেগুলো ইন্সপেকশন (পরিদর্শন করব)। তারপর রি রোলিং কারখানা আছে, জাহাজভাঙ্গা- এগুলো আমরা পরিদর্শন করব,’ বলছিলেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী।
হক বলেন, একসঙ্গে যেহেতু সব শিল্প পরিদর্শনের আওতায় আনা সম্ভব নয় সেজন্য সরকার অগ্রাধিকার নির্ধারণ করেছে। এ দৃষ্টিতে তৈরি পোশাক খাত বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।