২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত সবই ছিল সাভারের রানা প্লাজার নিউওয়েভ ও নিউওয়েভ বটম কারখানার মালিক মাহমুুদুর রহমান তাপসের। রাজধানীর কল্যাণপুরে ছিল তার আরও একটি কারখানা। পাঁচ-পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ির মালিক তাপস থাকতেন রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে নিজের ফ্ল্যাটে। একাধিক ফ্ল্যাটের ভাড়া বাবদ গুনতেন মোটা অঙ্কের অর্থ। বৈধ আয়েই তার জীবনযাত্রাকে নিয়ে যান ‘রাজার হালে’। ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের পর তাপসের সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়। কালো মেঘ ভর করে তার জীবনে। রাজধানীর ‘রাজা’ এখন দিকভ্রান্ত পথিক। কলাবাগানে বোনের বাসায় থাকেন অনেকটা লজিং মাস্টারের মতো। রানা প্লাজার ভাড়াটিয়া হওয়ার কারণে মাথার ওপর ঝুলছে তিনটি মামলা। হতাশায় খানিকটা এলোমেলো তাপস সমকালকে বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন ও ভবনের মালিকের দোষ আমার ঘাড়ে। তিনটি মামলা চলছে। রায় যে কোনো দিন। মনে হয় ঝুলতে হবে। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আরও বলেন, বিন্দুমাত্র দোষ করিনি। ঝুলব, তবু দেশ ছাড়ব না।’
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের মর্মান্তিক ঘটনায় ওই ভবনের পাঁচ কারখানার দেড় ডজন উদ্যোক্তার অবস্থা প্রায় একই রকম। ওই দুর্ঘটনায় আহত দুই হাজারের মধ্যে অন্তত এক হাজার শ্রমিক নতুন করে আর কাজে ফিরতে পারেননি। চিকিৎসা ও পুনর্বাসনেও সহায়তা না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের। নিহত এক হাজার ১৩৮ শ্রমিকের মধ্যে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া ৫৫ জনের লাশ আজও শনাক্ত হয়নি। দুর্ঘটনার দুই মাসের কম সময়ের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক মানের শ্রমপরিবেশ না থাকার অভিযোগে শুল্কমুক্ত সুবিধা বা জিএসপি স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। সেই স্থগিতাদেশ আজও প্রত্যাহার হয়নি।
তবে ওই এক ঘটনায় বদলে যেতে শুরু করে বাংলাদেশের পোশাক খাত। ছোট-বড় প্রায় সাত হাজার পোশাক কারখানায় শুরু হয় ব্যাপক সংস্কার অভিযান। পরিকল্পিত সংস্কার কার্যক্রম এখন শেষ পর্যায়ে। এতে কারখানা ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহি ও উৎপাদন কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখ করার মতো বাড়ছে। তিন ডলারের গোলগলা গেঞ্জি ও পাঁচ ডলারের সাধারণ শার্ট, প্যান্ট থেকে শুরু করে ২০০ ডলারের পশ্চিমাদের বিয়ের পোশাক পর্যন্ত তৈরির সক্ষমতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, ব্যাপক সংস্কার ও অভিজ্ঞতার কারণে উচ্চমূল্যের পোশাকের ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশের কদর দিন দিন বাড়ছে। নিখুঁত উৎপাদনের স্বার্থে রোবটও কাজ করছে। সবদিক দিয়েই বিশ্বের সবচেয়ে ভালো মানের পোশাক কারখানা এখন বাংলাদেশে। নিরাপদ ও কর্মপরিবেশ বিবেচনায় বিশ্বের শীর্ষ ১০টি কারখানার সাতটিই আমাদের দেশে। শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও পরিবেশসম্মত উৎপাদনের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গ্রিন সনদ পাওয়া কারখানার সংখ্যা ৬৭টিতে পেঁৗছেছে। এ সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও ২২৭টি কারখানা।
অন্যদিকে সংস্কার চালিয়ে যেতে ব্যর্থ প্রায় ২ হাজার কারখানা বন্ধ করা হয়েছে। এ কারণে রানা প্লাজা ধসের চার বছরের মধ্যে আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। ব্যাপক সংস্কারের ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাত এতদূর এগিয়েছে বলে স্বীকৃতি দিয়েছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারাই। বাংলাদেশের পোশাক খাতের সংস্কারবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটির (অ্যালায়েন্স) কান্ট্রি ডিরেক্টর ও ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির সাবেক রাষ্ট্রদূত জিম মরিয়ার্টি সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছেন, রানা প্লাজা ধসের পর অ্যালায়েন্সের কাজ শুরুর পর জোটের প্রায় ৭০০ কারখানায় কোনো দুর্ঘটনার দুঃসংবাদ পেতে হয়নি। অগ্রগতির এটাই বড় প্রমাণ।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রানা প্লাজা ধসের পরপর ‘জেগে ওঠা’ মনোভাব নিয়ে ধারাবাহিক সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগোচ্ছে পোশাক খাত। দুর্ঘটনার পরপরই সব কারখানার ত্রুটি শনাক্ত করার কাজ শুরু হয় ক্রেতাদের দুই জোট ইউরোপের অ্যাকর্ড, উত্তর আমেরিকার অ্যালায়েন্স ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে। এরপর ক্রেতাদের জোট, সরকার, জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ কয়েকটি দাতা সংস্থা এবং পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অংশগ্রহণ ও তত্ত্বাবধানে সংস্কার কাজ চলছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের কারখানার সংস্কার শেষ পর্যায়ে রয়েছে। দুই জোটের পাঁচ বছরের চুক্তি শেষে আজীবন সংস্কারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকার রেমিডিয়েশন কো-অর্ডিনেশন সেল (আরসিসি) গঠন করছে। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স, সিভিল সোসাইটি, মালিক ও শ্রমিক সব পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে আরসিসি গঠিত হচ্ছে। এর ফলে সংস্কারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সমকালকে বলেন, আরসিসির অধীনে সংস্কারেও গুণগত দিকটি বজায় রাখার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।
এক কলে সব সমস্যার সমাধান: পোশাক খাতে কর্মপরিবেশ উন্নয়নের পাশাপাশি শ্রমিকদের ক্ষমতায়নের কাজেও সাফল্য এসেছে। এখন কর্মপরিবেশের নিরাপত্তা কিংবা মজুরিসহ যে কোনো সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক প্রতিকার পাচ্ছেন শ্রমিকরা। কয়েকটি মোবাইল নম্বর দেওয়া একটি হেল্পলাইন কার্ড এখন শ্রমিকদের হাতে হাতে। এই নম্বরে বিনা খরচে সপ্তাহের সাত দিন ২৪ ঘণ্টায় যে কোনো অভিযোগ জানাতে পারবেন শ্রমিকরা। অভিযোগের ভিত্তিতে সমাধানও দেওয়া হচ্ছে। হেল্পলাইন স্টাফরা শ্রমিকদের কল থেকে কিছু তথ্যও সংগ্রহ করেন। শ্রমিকরা চাইলে তাদের নাম গোপন রাখা হয়। এই তথ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কারখানা ব্যবস্থাপককে জানানো হয়, যেন কারখানা কর্তৃপক্ষই সমস্যার সমাধান দিতে পারে। সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষ কী পদক্ষেপ নিয়েছে তা জেনে অভিযোগকারী শ্রমিককেও অবহিত করা হয়। গুরুতর নিরাপত্তাবিষয়ক সমস্যা অ্যালায়েন্স এ-সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের জানায়। তারা দ্রুত যাচাই-বাছাই শেষে সমস্যা সমাধান করেন।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রাজধানীর মিরপুরের একটি পোশাক কারখানার মালিক সমকালকে জানান, তার কারখানা ভবনের দেয়ালে চিকন ফাটল দেখে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ করে দেয়। তিনি বলেন, আমাকে কিছু না জানিয়ে হেল্পলাইনে ফোন করে অ্যালায়েন্সের প্রকৌশলীদের কারখানায় ডেকে আনে। তারা এসে বলেছেন, চিকন ফাটল নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়; কাজ চালিয়ে যেতেও কোনো সমস্যা নেই। কর্মকর্তাদের বক্তব্যে আশ্বস্ত হয়ে শ্রমিকরা কাজ শুরু করে।