যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত চেইনশপ ওয়ালমার্টের সঙ্গে কাজ করেন এমন বাংলাদেশি পোশাক কারখানার মালিকরা সম্প্রতি এই ক্রেতার কাছ থেকে একটি ই-মেইল পেয়েছেন। চিঠিতে চলমান কমপ্লায়েন্স কার্যাদির সময়সীমা কমিয়ে আগের চেয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে কাজ সমাধানের তাগাদা দেওয়া হয়। অন্যথায় কারখানাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের প্রচ্ছন্ন হুমকি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অন্যতম বৃহত্ ক্রেতার কাছ থেকে এমন ই-মেইল পেয়ে আতঙ্কিত বোধ করছেন অনেক পোশাক কারখানার মালিক। অনেকেই আগের চেয়ে বেশি লোকবল নিয়োগ করে নির্ধারিত সময়ের আগেই কমপ্লায়েন্স কাজ শেষ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। জানা গেছে, কমপ্লায়েন্স ইস্যুকে চাপে রাখতেই ওয়ালমার্ট এই কৌশল নিয়েছে। তবে হঠাত্ করে এ ধরনের চাপ সামলাতে গিয়ে ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে কারখানা মালিকদের।
চট্টগ্রাম ইপিজেডের ডেনিম প্লাস (বিডি) লিমিটেড নামের দেশি-বিদেশি মালিকানাধীন কারখানায় উত্তর আমেরিকার তৈরি পোশাক ক্রেতাদের সংগঠন অ্যালায়েন্স কর্তৃপক্ষ আগামী ১৫ আগস্টের মধ্যে কমপ্লায়েন্সের কাজ শেষ করার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়। ১৫ আগস্টকে নির্ধারিত সময় ধরে ডেনিম প্লাস কর্তৃপক্ষ বৈদ্যুতিক, ভবন ও আগুন নিরাপত্তাসহ কমপ্লায়েন্সের যাবতীয় কাজ শেষ করার পরিকল্পনা করে। সেই হিসেবে কাজের অগ্রগতিও হচ্ছিল। কিন্তু গত সপ্তাহে হঠাত্ করে তাদের ক্রেতা ওয়ালমার্ট থেকে একটি ই-মেইল আসে। যেই চিঠিতে কমপ্লায়েন্সের কাজ এক মাস এগিয়ে এনে ১৫ জুলাই এর মধ্যে শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। নির্ধারিত সময়ে তাদের পরিদর্শক দল কাজের অগ্রগতি না পেলে সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতি খুব বেশি অনুকূল হবে না বলে হুমকিও দেওয়া হয়। এরপর থেকে স্বাভাবিকভাবেই কারখানা কর্তৃপক্ষ খুবই অস্বস্তিতে পড়ে। ক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি বাধ্য হয়ে কাজের অগ্রগতিও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এ প্রসঙ্গে ডেনিম প্লাসের ঊর্ধ্বতন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ইউসুফ হোসাইন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চিঠি পাওয়ার পর থেকেই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এ বিষয়ে এখনো আলাপ-আলোচনা চলছে। তবে আমরা নিজ তাগিদেই ১৫ আগস্টের পরিবর্তে ৩০ জুলাইয়ের মধ্যে কাজ শেষ করার পরিকল্পনা নিয়েছি। ’
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, গত অর্থবছরে ২৮ বিলিয়ন ইউএস ডলার সমপরিমাণ তৈরি পোশাক বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে সুইডেনের বিখ্যাত এইচঅ্যান্ডএম সর্বোচ্চ প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য কিনেছে বাংলাদেশ থেকে। এর পরেই আছে ওয়ালমার্ট। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক রিটেইল কম্পানিটি গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে আড়াই বিলিয়ন ডলার বা ২০ হাজার কোটি টাকার পণ্য কিনেছে।
ওয়ালমার্ট থেকে কমপ্লায়েন্সের জন্য তাগাদা দেওয়া ই-মেইল পেয়েছেন এমন বেশ কয়েকজন কারখানা মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশির ভাগ কারখানাকে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য বলা হয়েছে। এর মধ্যে অনেকে আগে থেকেই কাজ প্রায় গুছিয়ে এনেছে। কিন্তু যারা কমপ্লায়েন্সের জন্য বিপুল অঙ্কের টাকা গোছাতে গিয়ে কাজ শুরু করতে দেরি করেছে তারাই বেশি বিপদে পড়েছে। কারণ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে কারখানা কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কারখানা মালিক বলেন, ‘ওয়ালমার্টের নতুন অর্ডার দেওয়ার সময় এসেছে। এ কারণে কারখানা কমপ্লায়েন্স করার তাগাদা বাড়ছে। যারা অন্তত ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ কাজ শেষ করবে তাদেরও অর্ডার দেবে ওয়ালমার্ট। এটা ওয়ালমার্টের একটা কৌশল। ’
কিন্তু ওয়ালমার্টের এই চিঠি পাওয়ার পর থেকে কারখানা মালিকদের কাছ থেকে কমপ্লায়েন্স কাজ দ্রুত শেষ করার চাপ বেড়েছে। চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী ইপিজেডের বেশ কয়েকটি কোরিয়ান কারখানার কমপ্লায়েন্স নিয়ে কাজ করছে চট্টগ্রামের লাকী এন্টারপ্রাইজ। এই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চিঠি পাওয়ার পর থেকে গত তিন সপ্তাহ ধরে কারখানা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রচণ্ড চাপে আছি। আমাদের সঙ্গে হয়তো কোনো কারখানার ৪ মাসের চুক্তি আছে। কিন্তু তারাও চুক্তির এক মাস আগে কাজ শেষ করার চাপ দিচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়ে বাড়তি লোকবল নিয়োগ করে কাজ করার চেষ্টা করছি। এতে আমাদের খরচও বেড়ে যাচ্ছে। ’
অ্যালায়েন্সের কাছ থেকে নতুন করে চাপ সৃষ্টির বিষয়ে বিজিএমইএর প্রথম সহসভাপতি মঈনুদ্দিন আহমেদ মিন্টু বলেন, ‘এমনভাবে চাপ দিচ্ছে যে অনেক ক্ষেত্রে তারা বায়ারদের কথাও শুনছে না। যেটা অনেকটা নৈরাজ্যের পর্যায়ে। আমরা বিজিএমইএর পক্ষ থেকে তাদের সঙ্গে এ নিয়ে যোগাযোগ করছি। যদি এভাবে অনৈতিক চাপ অব্যাহত থাকে তাহলে কমপ্লায়েন্স খাতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অনেক মালিক পথে বসবে। ’