কারখানায় শ্রম অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ ইস্যুতে সাসটেইনেবল কমপ্যাক্টের চাপের মুখে দেশের গার্মেন্টস খাত। ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজ করা, আইএলওর মান অনুযায়ী শ্রম আইন সংশোধন, সরকারী প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতা বাড়ানো ও স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠার মতো ইস্যুগুলো আবার সামনে নিয়ে এসেছে কমপ্যাক্ট। টিকফা ফোরামের বৈঠকের পরবর্তী দিন আগামী ১৮ মে ঢাকায় সাসটেইনেবল কমপ্যাক্টের তৃতীয় সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই সভার ইতিবাচক ফলের ওপর জিএসপি ও পোশাকের ন্যায্য দাম নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি নির্ভর করছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
এদিকে শ্রম অধিকার ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে কমপ্যাক্টের মূল্যায়ন সন্তোষজনক না হলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি সুবিধা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। কানাডার শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধাও হারাতে পারে বাংলাদেশ। তবে রানা প্লাজা ধসের পর গত চার বছরে দেশের গার্মেন্টস খাতে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে শ্রম অধিকার রক্ষা এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে বাংলাদেশ এ্যাকশন প্ল্যানের ১৬টি শর্তপূরণ করতে সক্ষম হয়েছে।
জানা গেছে, চার বছর আগে রানা প্লাজা ধসের পর দেশের গার্মেন্টস কারখানাগুলো শ্রমবান্ধব করতে বাংলাদেশ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সমন্বয়ে গঠিত হয় সাসটেইনেবল কমপ্যাক্ট। পরবর্তীতে সাসটেইনেবল কমপ্যাক্টে যোগ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা।
মূলত ট্রেড ইউনিয়ন, কারখানার ভবন, অগ্নি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং শিল্পের সঙ্গে জড়িত সবপক্ষের দায়িত্বশীল আচরণ নিশ্চিত করাই ছিল কমপ্যাক্টের প্রধান দায়িত্ব। এসব বিষয় সামনে রেখেই পশ্চিমা প্রতিনিধিরা পোশাক খাতে সরকারের নেয়া উদ্যোগ পর্যালোচনা করেছেন। রাজধানীর হোটেল রেডিসন ব্লু-তে অনুষ্ঠিতব্য বৈঠকে কমপ্যাক্টের অংশীদারদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এবারের বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী ট্রেড রিপ্রেজেনটেটিভ মি. মার্ক লিনসকট মার্কিন প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন।
ইতোপূর্বে কমপ্যাক্টের দ্বিতীয় পর্যালোচনা সভায় পোশাকশিল্পের শ্রম নিরাপত্তায় সরকারের কর্মসূচী নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রতিনিধিরা। তবে এবারের পর্যালোচনা সভার আগেই জিএসপি সুবিধা দেয়া ইইউ তাদের শর্ত মানতে বাংলাদেশকে বাধ্য করতে চাইছে। ট্রেড ইউনিয়ন ইস্যুতে তারা এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের প্রাপ্য জিএসপি সুবিধা স্থগিতের হুমকি দিচ্ছে। ইতোমধ্যে ইইউ জানিয়ে দিয়েছে, সাসটেইনেবল কমপ্যাক্ট বৈঠকে বাংলাদেশ অংশীদারদের সন্তুষ্ট করার জন্য শেষবারের মতো সময় পাবে। তারা বলেছে, ওই সময় তৈরি পোশাক খাতে শ্রম-ইস্যু ও মানবাধিকার প্রশ্নে সরকারের স্পষ্ট জবাব পাওয়া না গেলে তারা (ইইউ) পরের মাস অর্থাৎ জুনে একটি অনুসন্ধান দল পাঠাবে। ওই দলটি বাংলাদেশের (ইইউয়ের কাছে প্রাপ্ত) জিএসপি সুবিধা স্থগিতের বিষয়টি পর্যালোচনা করবে।
এছাড়া এবারের বৈঠবে ইইউয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাও থাকবে। তারাও বাংলাদেশের শ্রম ইস্যুর পাশাপাশি মানবাধিকার এবং সুশাসন ইস্যুতে সরকারের অবস্থান জানতে চাইবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক উর্ধতন কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ইইউয়ের অবস্থান সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইপিজেডে শ্রমিকদের কল্যাণে ওয়েলফেয়ার এ্যাসোসিয়েশন করার পরামর্শ দিয়েছেন। এর আগে গত ২০ এপ্রিল জার্মানির একটি প্রতিনিধি দল বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়নের পরামর্শ দেয়ার পর বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ইপিজেডে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের বিষয়ে সরকার বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। রানা প্লাজা ধসের পর ইইউ এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ের দেয়া বেশিরভাগ শর্ত বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছে এমনটি উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা জানান, ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন সুবিধাসহ দু-একটি ইস্যুতে মতভেদ রয়েছেÑ অংশীদারদের সঙ্গে যা নিয়ে আলোচনা চলছে। অবশ্য এখন তারা আবার গত ফেব্রুয়ারিতে সাভার ও আশুলিয়াতে ঘটে যাওয়া শ্রমিক অসন্তোষ ও সেই প্রেক্ষিতে করা মামলাগুলো নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। আগামী ১৮ মে কমপ্যাক্ট পর্যালোচনা সভায় সিএএস (কমিটি অন দ্য এ্যাপ্লিশেন অব স্ট্যান্ডার্ড ) বর্ণিত স্পেশাল প্যারাগ্রাফের বিষয়ে একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশকে স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে।
জানা গেছে, আইএলও এবং কমিটি অন দ্য এ্যাপ্লিকেশন অব স্ট্যান্ডার্ডের দেয়া সুপারিশের মধ্যে ৪টি বিষয় রয়েছেÑ যেগুলো জানতে চাওয়া হবে। বিষয়গুলোর অন্যতম হলোÑ বাংলাদেশ শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ, ইপিজেড আইনের প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ এবং ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিতকরণ প্রসঙ্গ।
এদিকে, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত তিন বছরে মারাত্মক ত্রুটি পাওয়া গেছে শতকরা ২ ভাগ গার্মেন্টস কারখানায়। যে কোন শিল্পের ২ শতাংশ কারখানায় ত্রুটি থাকা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। এই বাস্তবতায় দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির সক্ষমতায় বেশ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, মালিক, শ্রমিক এবং সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতা ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে গত চার বছরে পোশাক কারখানায় কোন বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। কারখানাগুলোতে কর্মবান্ধব পরিবেশ বিরাজ করছে। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে, শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। অগ্নিকা–প্রতিরোধে ফায়ার সেফটি ডোর আমদানি শুল্কমুক্ত করা হয়েছে।
জানা গেছে, সাসটেইনেবিলিটি কমপ্যাক্ট সামনে রেখে শ্রম পরিদর্শক নিয়োগ, ইপিজেড আইন সংশোধন, সাধারণের প্রবেশযোগ্য ডাটাবেজ স্থাপন, রফতানিমুখী গার্মেন্টস কারখানা যাচাই-বাছাই ও ট্রেড ইউনিয়নকে রেজিস্ট্রেশন প্রদান করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহসভাপতি (অর্থ) মোহাম্মদ নাসির জনকণ্ঠকে বলেন, নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং শ্রম অধিকার রক্ষায় উদ্যোক্তারা সর্বশক্তি দিয়ে কাজ করছেন। চালু থাকা বেশিরভাগ কারখানা কমপ্লায়েন্সের বিষয়গুলো অনুসরণ করছে। ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। এছাড়া শ্রম অধিকার সংক্রান্ত যেসব আইনকানুন রয়েছে তা পালন করছেন গার্মেন্টস মালিকরা। তিনি বলেন, বিজিএমইএ থেকে কারখানাগুলো নিয়মিত পরিদর্শন করা হচ্ছে। কোন ত্রুটি পেলে তা সংশোধনে মালিকপক্ষ নির্দেশ দিচ্ছে বিজিএমইএ। কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক চাপ কমছে না।
পোশাকশিল্প খাতের বড় সংগঠন বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত চার বছরে দেশের গার্মেন্টসশিল্পে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরিতে উদ্যোক্তারা সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছেন। এ কারণে দেশে এখন গ্রিন গার্মেন্টস গড়ে উঠছে। শুধু তাই নয়, নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরির অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করছেন উদ্যোক্তারা। তাই আগামীতে দেশের এ শিল্পে শতভাগ নিরাপদ কর্মপরিবেশ তৈরি হবে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মতো আর যাতে কোন ট্র্যাজেডি না হয় সে লক্ষ্যে বিজিএমইএ থেকে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। এছাড়া সরকারী বিভিন্ন সংস্থাও এখন নিয়মিত তদারকি করছে।