তৈরি পোশাক রফতানিতেও মন্দাভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম চার মাসে এ খাতের রফতানি আয় গত বছরের একই সময়ের চেয়ে কমে গেছে। সাধারণত একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে প্রধান এ খাতের রফতানি আয় আগের চেয়ে বাড়ে। মাঝে মাঝে বৃদ্ধির হার আগের চেয়ে কম হলেও ঋণাত্মক ধারায় যায় না। দীর্ঘদিন পর এখন সে অবস্থায় নেমেছে পোশাক রফতানি। আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এ চার মাসে রফতানি আদেশও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় কমেছে। রফতানির পাশাপাশি এ খাতে বিনিয়োগের অবস্থাও করুণ। বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে জানিয়েছেন, গত চার মাসে পোশাক খাতে এক টাকাও বিনিয়োগ হয়নি। এ কারণে রফতানিতে মন্দাভাব দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অবস্থার পরিবর্তন না হলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সংস্কার করা কারখানাও এক পর্যায়ে বন্ধ হয়ে যাবে। এর ফলে জাতীয় অর্থনীতিতে সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রভাবটা এখনই ভেবে দেখতে হবে। মোট
রফতানির মধ্যে পোশাকই হলো ৮০ ভাগের ওপরে। এদিকে রেমিট্যান্স একটানা কমছে। সব মিলে অর্থনীতিতে কমবেশি নেতিবাচক প্রভাবের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অর্থবছরের হিসাবেও রফতানির চিত্র প্রায় একই রকম। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) চলতি অর্থবছরের গত ১১ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) ওভেনের (শার্ট-প্যান্ট) রফতানি আগের একই সময়ের তুলনায় কম হয়েছে শূন্য দশমিক ৩৩ শতাংশ। রফতানি আদেশ পাওয়ার পর পোশাক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানির অনুমতি নিতে হয়। ইউটিলাইজেশন ডিক্লারেশনের (ইউডি) নামে এ অনুমতি দেয় বিজিএমইএ। বিজিএমইর তথ্য মতে, গত চার মাস ধরে ইউডি কমছে। গত বছরের জানুয়ারিতে ইউডির সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫৯৫টি। এ বছরের জানুয়ারিতে তা কমে হয় দুই হাজার ৫৭৭টি। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতেও একই অবস্থা। এ সময় আগের বছরের দুই হাজার ৮০০ থেকে ইউডির সংখ্যা দুই হাজার ৭২৩টিতে নেমে এসেছে। এ প্রবণতা অব্যাহত আছে বলে সূত্র জানিয়েছে। ফলে রফতানি আদেশ কমে যাওয়ার প্রভাব দেখা যাবে আগামী কয়েক মাসের রফতানি আয়ে। সাধারণত রফতানি আদেশ পাওয়ার পর ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রেতার কাছে পণ্য পেঁৗছাতে অন্তত দুই থেকে আড়াই মাস সময় লাগে। সে হিসেবে বর্তমান ইউডির তথ্য অনুযায়ী, আগামী মাসগুলোর রফতানি আয় গতিশীল হবে না।
সম্প্রতি ঢাকায় পোশাক খাত নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদও বলেছেন, ডলারের বিপরীতে ইউরোর দর পতন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়ার (ব্রেক্সিট) কারণে রফতানি আয় কমছে। এ দুই কারণে এ বছরও রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সম্ভাবনা নেই। গত ছয় বছর ধরেই পোশাক খাতে রফতানির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না।
বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানের মতে, বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে এখানও মন্দাভাব বিদ্যমান। সে কারণে পোশাকের চাহিদা ও দর কমছে। ডলারের বিপরীতে ইউরোর দর পতন এবং ব্রেক্সিটের মতো বড় কারণ তো আছেই। পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতিযোগিতায় থাকা দেশুগুলো বিভিন্ন হারে প্রণোদনা দিচ্ছে। স্থানীয় মুদ্রার দর কমিয়ে রফতানি খাতে সুরক্ষা দিচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে টাকা শক্তিশালী করে রাখা হয়েছে। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সব বাজারে রফতানির জন্য ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেওয়া উচিত। অন্তত আগামী দুই বছর রফতানিতে উৎসে কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিই বড় কারণ নয়। এ পরিস্থিতির মধ্যেও ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার রফতানি বাড়ছে। প্রতিযোগিতা সক্ষমতায়ও পিছিয়ে পড়েছেন এ দেশের রফতানিকারকরা। উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা একটা পর্যায়ে এসে এখন থেমে আছে। এ ছাড়া উৎপাদনশীলতাও যথেষ্ট নয়। ব্যবসা পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচও কমানো যাচ্ছে না। পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে তার পরামর্শ হচ্ছে, সরকারের পক্ষ থেকে মুদ্রা বিনিময় হার সমন্বয় এবং ব্যবসা পরিচালন ব্যয় কমিয়ে আনার ব্যবস্থা করা। আর উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, পোশাক পণ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য আনা ও লিড টাইম কমিয়ে আনার কৌশল নিতে হবে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) এবং বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের গত চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) পোশাক রফতানি হয়েছে ৯৫০ কোটি ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ কম । গত বছরের ওই চার মাসে রফতানি আয় বেশি ছিল ১৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। পোশাকের দুই খাতের মধ্যে নিটের (গেঞ্জি জাতীয় পোশাক) তুলনায় ওভেনের রফতানি পরিস্থিতি বেশি খারাপ। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিট রফতানি আয় চার শতাংশের মতো বেড়েছে। তবে ওভেনের আয় আগের তুলনায় কম হয়েছে ৩ দশমিক ১৫ শতাংশ। ওভেনের এই ছন্দপতনের কারণ জানতে চাইলে এ খাতের উদ্যোক্তা টেক্সওয়েভের এমডি আশিকুর রহমান তুহিন সমকালকে বলেন, গ্রীষ্ম মৌসুমকে সামনে রেখে ওভেনের তুলনায় নিটের চাহিদা বেশি। এ কারণে গত কয়েক মাস তুলনামূলক ওভেন কিছুটা খারাপ যাচ্ছে। এ ছাড়া বিশ্ব ফ্যাশন বাজারে পরিবর্তন এসেছে। কিছু আইটেম দ্রুতই ক্রেতার কাছে পেঁৗছানোর চাহিদা থাকে। ওভেনের ফেব্রিক্স আমদানিনির্ভর। আমদানিতে একটা সময় ব্যয় হয়, তারপর আবার রফতানির জন্য সময় ব্যয়। নিটের ফেব্রিক্সের ৯০ শতাংশই দেশীয় উৎস থেকে সংগ্রহ করা হয়। আমদানিতে তাদের সময়ের প্রয়োজন নেই। সে কারণে নিটের তুলনায় ওভেনের পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছে।
সূত্র মতে, ছোট-বড় প্রায় সব বাজারেই রফতানি কমেছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান তিন বাজার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং কানাডায় বড় অঙ্কে রফতানি কমেছে এ সময়। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে কমেছে ৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি কমে যাওয়ায় দেশটিকে টপকে জার্মানি এখন বাংলাদেশের পোশাকের প্রধান বাজার। কানাডায় কমেছে ৫ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে কমেছে ৬ শতাংশ। উদীয়মান বা নতুন বাজার শ্রেণিতে একই অবস্থা। এ শ্রেণির প্রধান বাজার জাপানে রফতানি কমেছে ১ শতাংশ। ভারতে ৮ শতাংশ ও মেক্সিকোতে ১৭ শতাংশ কমেছে। মোট আয়ে উদীয়মান বাজারের অবদান ১৬ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
কয়েকজন উদ্যোক্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আমদানি পর্যায়ে কাঁচামালের দর কিছুটা কম হওয়ার কারণেও রফতানি আয় কমেছে। এ ছাড়া গত এক বছরে বন্ধ হয়ে যাওয়া এক হাজার ২০০ কারখানা রফতানিতে কোনো অবদান রাখতে না পারায় ওইসব কারখানার উৎপাদন এবং রফতানি আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ। চলমান সংস্কার কার্যক্রমে তাল মেলাতে না পারা ২৫০টি, প্রাথমিক পরিদর্শনে ৪০টি ও বিভিন্ন কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে না পারায় বাকি কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে।