ঈদ এলেই কিছু গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ করে শ্রমিকদের বেকার করা নিয়মে পরিণত হয়েছে। গত কয়েক বছরের মতো এবারও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এবারের ঈদুল ফিতরের ছুটি আসতে না আসতেই বন্ধ হয়েছে ১০-১২টি গার্মেন্টস কারখানা। আর এতে ঈদের আগে বেকার হয়ে গেছে লক্ষাধিক শ্রমিক। বন্ধ হওয়া এসব গার্মেন্টস কারখানার বেশ কয়েকটিতে শ্রমিকদের পাওনাও পরিশোধ করা হয়নি। ফলে ঈদ উত্সবের আগে কিছু গার্মেন্টস শ্রমিকের সঙ্গী হয়েছে আনন্দের বদলে চোখের পানি। এবার ঈদুল ফিতরের আগে গার্মেন্টস খাতে উত্সব ভাতা ঈদ বোনাস নিয়ে কোনো ঝামেলা না হলেও এ মাসের বেতন মেলেনি অনেক শ্রমিকের ভাগ্যে। বিজিএমইএ নেতা ও শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকাল পর্যন্ত ৯০ শতাংশ গার্মেন্টস কারখানায় উত্সব ভাতা প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু চলতি মাসের পূর্ণাঙ্গ বেতন দেওয়া হয়নি কোনো গার্মেন্টস কারখানায়। অবশ্য চলতি মাসের বেতন নিয়ে শ্রমিক-মালিক সমঝোতার মাধ্যমেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাধান হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কোনো কারখানায় ৫০ শতাংশ, কোনো কারখানায় ৪০ শতাংশ আবার কোনো কারখানায় ২০ শতাংশ মজুরি দেওয়া হয়েছে চলতি মাসের। এ বিষয়ে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গতকাল সকালের খবরকে বলেন, এবার ঈদের আগে বেতন-বোনাস নিয়ে তৈরি পোশাক খাতে কোনো সঙ্কট নেই। আমার জানা মতে, ইতোমধ্যে শতভাগ কারখানায় উসব ভাতা প্রদান করা হয়েছে। তবে চলতি মাসের বেতন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া চলতি মাসের বেতন এখনই চাওয়াটাও অন্যায়। কারণ মাসের এখনও সপ্তাহখানেক বাকি। মাস শেষ না হলে বেতন কীভাবে দেওয়া যায়। অবশ্য অনেক কারখানার মালিকরা যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী বেতন পরিশোধ করেছেন। শ্রমিক নেতারা বলছেন, মাস শেষ না হলেও ঈদের আগে চলতি মাসের বেতন দেওয়া গার্মেন্টস মালিকদের নৈতিক দায়িত্ব। এ বিষয়ে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি সকালের খবরকে বলেন, গত মাসের যে বেতন শ্রমিকরা পেয়েছে তা ঘরভাড়া ও সংসার খরচেই শেষ হয়ে গেছে। গার্মেন্টস মালিকরা উত্সব ভাতা হিসেবে শ্রমিকদের যে অর্থ দেন তা যত্সামান্য। শ্রমিকের মূল বেতনের অর্ধেকও দেওয়া হয় না উত্সব ভাতা। এতে কোনো শ্রমিক দেড় হাজার টাকা বা কেউ দুই হাজার টাকা পেয়ে থাকে। বেতন না দিলে উত্সব ভাতার এই সামান্য অর্থ দিয়ে শ্রমিকরা কীভাবে ঈদ উদযাপন করবে। এ জন্য আমাদের দাবি ছিল ঈদের আগে গার্মেন্টস শ্রমিকদের চলতি মাসের পূর্ণাঙ্গ বেতন দেওয়ার। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, গার্মেন্টস মালিকরা সেটা করেননি। কিছু কারখানায় চলতি মাসের মজুরি সামান্য দেওয়া হলেও অধিকাংশ কারখানায় এ মাসের মজুরি কিছুই দেওয়া হচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের ঈদের আগে ইতোমধ্যে বিভিন্ন এলাকায় ১০-১২টি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এসব গার্মেন্টস কারখানা গাজীপুর, আশুলিয়া এবং ঢাকা সিটির মধ্যেও রয়েছে। বন্ধ হওয়া গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল, গাজীপুরের জিকন গার্মেন্টস লিমিটেড। কারখানাটিতে পাঁচ হাজারের অধিক শ্রমিক কাজ করত। বন্ধ হয়েছে আশুলিয়ার শেড ফ্যাশনস লিমিটেড। এখানেও কাজ করত তিন হাজারের অধিক শ্রমিক। এভাবে বেশ কয়েকটি কারখানা বন্ধ হওয়ায় এবার ঈদের আগে বেকার হয়েছে এক লাখের বেশি গার্মেন্টস শ্রমিক। শুধু যে কারখানা বন্ধের কারণে শ্রমিকরা বেকার হচ্ছে তা নয়, ঈদের আগে অনেক গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিক ছাঁটাইও চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আশুলিয়ার উইলিয়াম সোয়েটারের ৩০-৩৫ শ্রমিককে এবং রাজধানীর উত্তরার অপটিমাম লিমিটেড কারখানার ১০-১৫ শ্রমিককে ছাঁটাই করা হয়েছে। রাজধানীর তেজগাঁওয়ের ডেনিম ফ্যাশন ওয়্যারের দেড় শতাধিক শ্রমিক ছাঁটাই করেছে কারখানা কর্তৃপক্ষ। ঈদের আগে যেসব গার্মেন্টস কারখানার মালিক তাদের কারখানা বন্ধ করছেন, তারা কিছু যুক্তিও দেখিয়েছেন। তাদের সেসব যুক্তি বা কারণের মধ্যে রয়েছে-প্রথমত, কারখানায় পোশাকের রফতানি আদেশ না থাকা। দ্বিতীয়ত, ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের সংস্কার কাজের ব্যয় সঙ্কুলান করতে না পারা। তাছাড়া অনেক কারখানা মালিক আর্থিক সঙ্কটের কারণেও বন্ধ করছেন তাদের গার্মেন্টস কারখানা। কিন্তু কথা হচ্ছে বছরের অন্য কোনো সময় বন্ধ না করে ঈদের আগে দিয়ে কেন। এ ক্ষেত্রে গার্মেন্টস মালিকদের যুক্তি হচ্ছে, ঈদে একটি দীর্ঘ ছুটি পাওয়া যায়। এই ছুটির আগে শ্রমিকদের জানিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে ঈদের পর এসে তারা নতুন কোনো কারখানায় চাকরি জোগাড় করে নিতে পারে। অবশ্য অর্থনীতিবিদরা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা পরিচালক ড. খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন সকালের খবরকে বলেন, দীর্ঘ ছুটির কারণ দেখিয়ে ঈদের আগে কারখানা বন্ধ করা কখনও সমীচীন নয়। কারণ যেকোনো খাতেই হোক ঈদের ছুটির মধ্যে যদি কারও চাকরি চলে যায়, তার ঈদটাই মাটি হয়ে যায়। এটা কারও কাছেই সুখকর নয়। গার্মেন্টস মালিকরা যদি তাদের কারখানা বন্ধ করতে চান, তাহলে বছরের অন্য কোনো সময়ও করতে পারেন। তাছাড়া ঈদের ছুটির পর ঢাকায় ফিরে সব শ্রমিকই যে সঙ্গে সঙ্গে নতুন কোনো কারখানায় চাকরি পেয়ে যাবে, তাও ঠিক নয়। অনেকেই বেকার থাকবেন দুই-তিন মাস। আর গার্মেন্টস শ্রমিকরা যদি দুই মাস বেকার থাকে, তাহলে তার জন্য সেটা খুবই কষ্টের। এ দিকটি মালিকদের বিবেচনা করা দরকার। ঈদের আগে কারখানা বন্ধ করার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্যবসা না থাকলে তো কারখানা বন্ধ হবেই। যেসব মালিক তার কারখানা বন্ধ করছেন তাদের কারখানায় কাজ নেই। তাই তারা কারখানা বন্ধ করছেন। আর কারখানা বন্ধ হলে শ্রমিক বেকার হবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে যারা কারখানা বন্ধ করছেন তারা শ্রমিকদের পাওনা দিয়েই বন্ধ করছেন বলে আমি জানতে পেরেছি।