যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা বা জিএসপি স্থগিতের কারণে এর আওতায় থাকা পণ্যের রপ্তানি কমেছে ব্যাপকভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এসব পণ্য বাংলাদেশের রপ্তানি তালিকার মূল পণ্য নয়। তারপরও বড় অঙ্কের আয় কমে যাওয়ায় খাতগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অবশ্য গত প্রায় এক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান পণ্য তৈরি পোশাকেও রপ্তানি কমছে। দেশটিতে বছরে প্রায় ৬০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়।
২০১৩ সালের ২৭ জুন জিএসপি স্থগিতের ঘোষণার আগে প্লাস্টিক সামগ্রী, সিরামিক, চা, ফার্নিচার, সবজি, তামাক জাতীয় পণ্য, খেলার সরঞ্জাম, রান্নাঘরের সামগ্রী, গলফ সামগ্রী ও চশমা, লবণ, পাথর, সিমেন্ট, জাহাজসহ রপ্তানি তালিকার ছোটখাটো আরও কিছু পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে জিএসপি সুবিধা পেত। রপ্তানি খাতের প্রধান প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক, চিংড়ি, চামড়াসহ প্রধান পণ্যসহ বাকি পণ্যগুলো কখনও যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি সুবিধার আওতাভুক্ত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা পেতে পারে এমন তালিকায় ৫ হাজারের বেশি পণ্য রয়েছে। তবে বেশিরভাগই বাংলাদেশ রপ্তানি করে না।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, মার্কিন জিএসপি স্থগিতের পর থেকে চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত সে দেশে চায়ের রপ্তানি কমেছে ৮৫ শতাংশ, সিরামিকের কমেছে ২৬ শতাংশ, প্লাস্টিকের ২৩ শতাংশ এবং খেলনা রপ্তানি কমেছে ৭ শতাংশ।
তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং উদ্যোক্তা ও বাণিজ্য বিশ্লেষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উন্নয়নশীল এবং দরিদ্র ১২৭ দেশের জন্য মার্কিন জিএসপির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয় বাংলাদেশকে এ সুবিধা স্থগিতের প্রায় একই সময়ে। নবায়ন প্রক্রিয়ার শুরু এবং মার্কিন আইনি অনুমোদন পেতে দুই বছর সময় লাগে। এ দুই বছর সব দেশের পণ্যকেই শুল্ক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে হয়েছে। অবশ্য নবায়ন শেষে এ দুই বছরে আদায় করা শুল্ক ফেরত দেয়া হয়। এ কারণে জিএসপি স্থগিত সত্ত্বেও ওই দুই বছর বাংলাদেশ দর প্রতিযোগিতায় সব দেশের সঙ্গে সমান অবস্থানে ছিল। কিন্তু ২০১৫ সালে নবায়ন শেষে বাকি দেশগুলো আবার জিএসপি সুবিধায় রফতানি শুরু করলে ওইসব দেশের পণ্যের তুলনায় বাংলাদেশের পণ্যগুলো দর প্রতিযোগিতায় চ্যালেঞ্জে পড়ে। সে প্রভাবেই গত দুই বছরে বাংলাদেশের পণ্যগুলোর রপ্তানি কমতে থাকে।
জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানিতে জিএসপি স্থগিতের প্রভাব থাকতে পারে। তবে তা একমাত্র কারণ নয়। যুক্তরাষ্ট্রে ভোগ ব্যয় কমে অনেক পণ্যের চাহিদাই কমেছে। তিনি বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডবিস্নউটিও) দোহা রাউন্ডে উন্নত দেশগুলো স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যে নিজেদের দেশে প্রবেশে শুল্কমুক্ত প্রবেশ সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই এখনও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। সে কারণে বাংলাদেশের ৫ হাজার পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নয় এমন পণ্য স্থগিতের আগে মার্কিন জিএসপি সুবিধা ভোগ করত। জিএসপি ফেরতের সম্ভাবনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত সাসটেইনেবলিটি কমপ্যাক্টের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রও পরে যুক্ত হয়েছে। কমপ্যাক্টের অগ্রগতির সঙ্গেই এখন বিষয়টি জড়িত।
ইপিবির তথ্য অনুযায়ী, জিএসপি স্থগিতের আগের অর্থবছর ২০১২-১৩ অর্থবছরের তুলনায় পরের অর্থবছর (২০১৩-১৪) চায়ের রপ্তানি বেশি ছিল ৪৯ শতাংশ। প্লাস্টিক, সিরামিক, ফার্নিচার ও খেলনা রপ্তানিও বাড়ে। অন্যদিকে ওই বছর রপ্তানি কমে জাহাজের ৯৮ শতাংশ। অন্যান্য পণ্যে মিশ্র প্রবণতা দেখা যায়। পরের অর্থবছরও রপ্তানি চিত্র প্রায় একই রকম। তবে পরিবর্তন দেখা যায় ২০১৪-১৫ অর্থবছরে। এ সময় সব পণ্যের রপ্তানি কমেছে। চায়ের কমেছে ১১ শতাংশ, সিরামিকের ২৭ শতাংশ, প্লাস্টিকের ৩৫ শতাংশ, খেলনা ১০ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে কমেছে ৪৩ শতাংশ। এ সময় কোনো ফার্নিচার রপ্তানি হয়নি দেশটিতে। পরের অর্থবছর (২০১৫-১৬) পরিস্থিতি আরও খারাপ। এ বছর চায়ের কমেছে ১৫ শতাংশ, সিরামিক ৪ শতাংশ, প্লাস্টিক ১৩ শতাংশ, খেলনা ৩৯ শতাংশ ও অন্যান্য খাতে ১৯ শতাংশ কমেছে।
সিরামিকের রপ্তানি কমে যাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে এ খাতের বড় শিল্প গ্রুপ মুন্নু সিরামিকসের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক খোকন মিয়া জানান, প্রথম দুই বছর কোনো দেশের জন্য মার্কিন জিএসপি ছিল না। এতে বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিত থাকলেও ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিযোগিতা ছিল। জিএসপি নবায়ন করায় যেখানে অন্য দেশ শূন্য শুল্ক সুবিধা পাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশ তা পাচ্ছে না। এ কারণে গত দুই বছর ধরে রপ্তানি কমছেই।
রানা প্লাজা ধস ও তাজরিন ফ্যাশন্সে অগি্নদুর্ঘটনায় বহু শ্রমিকের প্রাণহানিতে আন্তর্জাতিকমানের শ্রম পরিবেশ না থাকার অভিযোগে ২০১৩ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশি পণ্যের জিএসপি সুবিধা স্থগিতের ঘোষণা দেয় ওবামা প্রশাসন। এরপর তিন দফা শুনানির পরও বাংলাদেশের জিএসপি স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার করা হয়নি। এ সংক্রান্ত মার্কিন শ্রম প্রতিনিধির কার্যালয় ইউএসটিআর বছরে দুবার এ বিষয়ে অগ্রগতি পর্যালোচনার কথা থাকলেও গত ডিসেম্বরের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো শুনানি হয়নি।