তৈরি পোশাক খাতের প্রায় ২০ কারখানা বন্ধ হয়েছে চলতি জুলাই মাসে। এই সংখ্যা এ বছরের জানুয়ারি থেকে প্রায় ৭০টিতে দাঁড়িয়েছে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, কারখানা সংস্কার এবং সাবকন্ট্রাক্টের কাজ না পেয়ে রাজধানী এবং রাজধানীর আশপাশের শিল্পাঞ্চলগুলো থেকে ঈদের ছুটিতে অনেক কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মূলত শ্রমিক অসন্তোষ এড়াতে ঈদের ছুটিকে কাজে লাগান মালিকরা।
শ্রমিক নেতারা বলেন, শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা না দিয়ে পার পেতে মালিকরা ঈদের ছুটিকে কারখানা বন্ধের উপযুক্ত সময় হিসেবে বেছে নেয়। ফলে ঈদের ছুটির পর পর শ্রমিকরা বাড়ি থেকে এসে দেখে কারখানায় তালা লাগানো। আবার কোনো কোনো কারখানা খুললেও কাজ নেই বলে শ্রমিকদের ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। পরে দেখা যায়, ওই সব কারখানায়
অনির্দিষ্টি সময়ের জন্য তালা ঝুলছে। তখন শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে তাদের পাওনা বুঝে নিতে ভিড় করে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের বিজিএমইএ কার্যালয়ে।
এদিকে বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, ঈদের ছুটির পর জুলাই মাসে বিজিএমইএ সদস্য কারখানা বন্ধ হয়েছে প্রায় ২০টি। এ ছাড়া চলতি বছরের গত ৭ মাসে বন্ধ হয়েছে ৭০টি কারখানা। তবে শ্রমিক নেতাদের মতে এই সংখ্যা আরো বেশি। এ নিয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডাআইএফই) মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, ‘গত এক মাসে আমাদের জানামতে কোনো কারখানা বন্ধ হয়নি। তবে রাজধানী ঢাকা থেকে স্থানান্তর হয়েছে ৩টি। কোনো কারখানা বন্ধ হয়েছে কি না এখন পর্যন্ত তাদের কাছে এ নিয়ে কোনো তথ্য নেই বলে জানান ডাইফির মহাপরিদর্শক। তিনি আরো জানান, কারখানা বন্ধ বা স্থানান্তর করতে হলে অবশ্যই ডাইফিকে অবহিত করতে হয়। বিজিএমইএ তথ্য ও পরিসংখ্যানের ব্যাপারে তিনি খোঁজ নেবেন বলে জানান।
এদিকে অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের পোশাক কারখানা সংস্কারে কাজ করা বিদেশি ক্রেতা সংগঠন অ্যার্কড ও অ্যালায়েন্স এবং ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যানের (এনএপি) নির্দেশনা অনুসারে কারখানা মালিকরা সংস্কার করতে না পারা, ভাড়াবাড়ি বা আবাসিক এবং বাণিজ্যিক ভবনে থাকা কারখানাগুলো পোশাক কারখানার উপযোগী না থাকা, ছোট সাবকন্ট্রাক্ট কারখানা সাবকন্ট্রাক্ট করতে না পারা এবং ঢাকা থেকে পর্যায়ক্রমে শিল্পাঞ্চলগুলোতে পোশাক কারখানা সরিয়ে নেওয়ার কারণে এসব কারখানা বন্ধ হচ্ছে বলে জানা যায়।
হঠাৎ এভাবে কেন কারখানা বন্ধ হচ্ছে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বিদেশি ক্রেতাদের জোট সংগঠনের সংস্কার চাপে পড়ে মালিকরা কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিনি গত সাত মাসের পরিসংখ্যান দিয়ে কালের কণ্ঠকে জানান, গতকাল বুধবার পর্যন্ত আমাদের সদস্য কারখানা বন্ধ হয়েছে ৬৮টি। আর শুধু এ মাসে ২৬ জুলাই পর্যন্ত বন্ধ হয়েছে ১৭টি কারখানা।
কারখানা বন্ধ ঈদের ছুটিতে কেন জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করে এক শ্রমিক নেতা জানান, রোজা শুরুর সময় থেকে ঈদ এবং কোরবানির ঈদ এই সময়ে (জুন থেকে সেপ্টেম্বর) মোট কর্মদিবস ১২০ দিন বা ৪ মাস। এ সময় মালিকদের দুই ঈদে ৭ দিন করে গড়ে ১৫ দিন ছুটি দিতে হয়। এ ছাড়া সাপ্তাহিকসহ অন্যান্য ছুটি ১৫ দিন। এভাবে ৪ মাসের মধ্যে মোট ৩০ দিন বা এক মাস কারখানা বন্ধ থাকে। দুই ঈদের ২টি মূল বেতনের সমান ২টি বোনাস অন্যান্য ভাতাসহ শ্রমিকদের প্রায় ৯০ দিন কাজ করিয়ে দিতে হয় ৬ মাসের সমপরিমাণ মজুরি। এর ফলে কারখানার মালিকরা খরচ বাঁচাতে রোজার ঈদের আগে বা পরে কারখানা বন্ধ করার সুযোগ নেন। তবে এবার রোজার ঈদের আগে শ্রমিক অসন্তোষ হওয়ার আশঙ্কায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ মালিকদের এ সুযোগ দেয়নি। ফলে রোজার ঈদের ছুটির পর এবং কোরবানির ঈদের আগের সময়টি কারখানা বন্ধের সময় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, শুধু জুলাই মাসে রাজধানী ঢাকার মিরপুর, বাড্ডা, রামপুরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, শ্যামলী এসব এলাকা থেকে প্রায় ২০টি, গাজীপুর ৪টি, আশুলিয়া ৩টি এবং নারায়ণগঞ্জে ৮টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। তবে এসব কারখানা সবাই বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ সদস্য নয়।
শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করে এ রকম একটি প্রতিষ্ঠান বিলসের নির্বাহী পরিচালক সুলতান উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এভাবে এক মাসে প্রায় ২০ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি উদ্বেগের বিষয়। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এবং এনএপির কারণে সক্ষমতার অভাবে বন্ধ হলে উদ্যোক্তাদের সহায়তা করতে সরকার ও বিজিএমইএকে এগিয়ে আসা উচিত। তবে বন্ধ যে কারণেই হোক শ্রমিকদের নায্য প্রাপ্য ও পুনর্বাসন করার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশনের বাবুল আখতার বলেন, কারখানার মালিকদের সক্ষমতা না থাকলে তাঁরা কারখানা বন্ধ করতে পারেন। কিন্তু শ্রম আইন শ্রমিকবান্ধব না হওয়ায় কারখানা বন্ধ বা স্থানান্তর হলে তাঁদের বেশি অসুবিধায় পড়তে হয়। আমার পরামর্শ কারখানা বন্ধের আগে শ্রমিকদের পাওনা কিছুটা বাড়িয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হোক।