Home Bangla Recent এশিয়ায় সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশে?

এশিয়ায় সর্বনিম্ন মজুরি বাংলাদেশে?

চার দশকে দেশের পোশাক শিল্পের উন্নতি অন্য রকম। ৪০ হাজার ডলারের রফতানি আয় পৌঁছেছে প্রায় ৩ হাজার কোটি ডলারে। স্ফীত হয়েছে মালিকদের সম্পদ। এর সবটাই সম্ভব করেছে সস্তা শ্রম। এ শিল্পের ভরসার জায়গাও এখনো নিম্ন মজুরিই। কয়েক দফা বেড়ে ৫ হাজার ৩০০ (৬৬ দশমিক ৮৮ ডলার) টাকায় পৌঁছেছে শ্রমিকদের নিম্নতম মাসিক মজুরি। তারপরও তা এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন।

এশিয়ার বিভিন্ন দেশের মজুরির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, কম্বোডিয়ায় ন্যূনতম মাসিক মজুরি ১৪০ ডলার। ভিয়েতনামে এ মজুরি প্রায় ১৪৭ ডলার, ফিলিপাইনে ২০২, ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় ১৬০, মালয়েশিয়ায় ২২৩, থাইল্যান্ডে ২৬৫, চীনে ২৩৪ ও মিয়ানমারে ৮০ ডলার। এছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভারতে নিম্নতম মাসিক মজুরি প্রায় ১৪৪ ডলার, পাকিস্তানে ১০৬, শ্রীলংকায় প্রায় ৬৯, নেপালে ৭৪ ও আফগানিস্তানে ৭৩ ডলার।

তবে জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনায় বাংলাদেশের বিদ্যমান এ মজুরিকেও সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক চুন্নু। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কমিশনের মাধ্যমে যে মজুরি নির্ধারণ করা হচ্ছে, বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে তা বাড়ানোর বিধান রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে মজুরি বৃদ্ধির এ হার ইতিবাচক। তাই আমাদের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বিদ্যমান মজুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।

দেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত পোশাক শিল্পে ১৯৮৫ সালে নিম্নতম মজুরি ছিল ৫৪২ টাকা। ১৯৯৪ সালে এটি বাড়িয়ে ৯৩০ টাকা করা হয়। এর এক যুগ পর ২০০৬ সালে মজুরি বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ৬৬২ টাকা। এর পর ২০১০ সালে নিম্নতম মজুরি বেড়ে হয় ৩ হাজার টাকা। সর্বশেষ ২০১৩ সালে নিম্নতম মজুরি ৫ হাজার ৩০০ টাকা নির্ধারণ করে মজুরি কমিশন। তবে মজুরি বৃদ্ধির জন্য প্রতিবারই আন্দোলন করতে হয়েছে শ্রমিকদের। অনেকটা নিয়ম মেনেই মজুরি বৃদ্ধিতে অনীহা দেখিয়েছেন শিল্প মালিকরা।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোশাক শিল্পে কর্মরতদের মধ্যে একটি বড় অংশ নিম্নহারে মজুরি পায়। এ খাতের ৮০ শতাংশ নারী শ্রমিকের মজুরি ৫ হাজার ৩০০ থেকে ৭ হাজার টাকার মধ্যে। অন্যদিকে ৭০ শতাংশ পুরুষ শ্রমিক ৫-৭ হাজার টাকা মজুরি পান।

অর্থনীতির প্রেক্ষাপট চিন্তা করলে মজুরিকে একমাত্র মানদণ্ড হিসেবে বিবেচনা করা সঠিক নয় বলে মনে করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, এর সঙ্গে আরো বেশকিছু বিষয় জড়িত। আমাদের কর্মদক্ষতা কতটুকু তা দেখতে হবে। চীনে মজুরি যেমন আমাদের চেয়ে বেশি, সেখানে কর্মদক্ষতাও বেশি। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে এখানে যে মজুরি দেয়া হয়, তা অন্য অনেক দেশের জীবনযাপন ব্যয়ের তুলনায় যথেষ্ট। আবার এখানে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে ভূমি অধিগ্রহণসহ অন্যান্য যেসব ব্যয় রয়েছে, তা তুলনামূলক বেশি। এসব বিষয়ই পরস্পর-সংশ্লিষ্ট। আরেকটি বিষয় হলো, দেশে শ্রমের মজুরি কম হলেও বাধ্যতামূলক বা জোরপূর্বক কাজে নিয়োজিতের ঘটনা নেই।

সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যানুযায়ী, আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে শ্রমশক্তি দেশের মোট জনসংখ্যার ৫৮ দশমিক ৫ শতাংশ। দেশের উৎপাদন, নির্মাণ, কৃষি ও মত্স্য খাতের শ্রমিকদের ন্যূনতম গড় মজুরি ৮ হাজার ৮৪৬ টাকা।

দেশের খাতভিত্তিক ন্যূনতম মজুরি মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে জানান বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, বিপুল জনগোষ্ঠী আমাদের দেশের জন্য সম্পদ। তবে এখানে বৈষম্যপূর্ণ মজুরি কাঠামো বিদ্যমান। বৈষম্যমূলক এ মজুরি কাঠামোর ফলে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও শ্রমের ক্ষেত্রে এক ধরনের এক্সপ্লয়টেশন রয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। তবে সদিচ্ছার অভাবে সেটি হচ্ছে না।

জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ইউএন-এসকাপ) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে শ্রম উৎপাদনশীলতায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বনিম্ন স্থানে। বাংলাদেশে শ্রমের গড় উৎপাদনশীলতা বছরে মাত্র ৮ হাজার ডলার। এর চেয়ে কম শ্রমের গড় উৎপাদনশীলতা রয়েছে শুধু কম্বোডিয়ায়। দেশটির শ্রমিকদের গড় উৎপাদনশীলতা ৬ হাজার ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকা ১৪তম, পাকিস্তান ২০ ও ভারত ২২তম স্থানে রয়েছে। দেশ তিনটির শ্রমের গড় উৎপাদনশীলতা যথাক্রমে ২৩ হাজার, ১৮ হাজার ও ১৫ হাজার ডলার।

সংস্থাটি তথ্য বলছে, শ্রমের মজুরির ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। নিম্ন উৎপাদনশীলতার এটি অন্যতম কারণ। এজন্য বিভিন্ন খাতে মজুরি বাড়ানোর প্রতি নজর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। কারণ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহূত উপকরণ তথা শ্রমের দক্ষ ব্যবহারের ওপর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে। কারণ শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেশি হলে অধিক বিনিয়োগ ও অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এছাড়া ব্যবহূত উপকরণগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি করা গেলে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি বাড়ে, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প মালিকরা সস্তা শ্রমকে শক্তির বদলে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন। এ কারণে বর্তমান বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী সক্ষমতা বৃদ্ধিতে শ্রমিকের দক্ষতা বৃদ্ধি অত্যন্ত জরুরি হলেও এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদ্যোগ নেই। পাশাপাশি শ্রমিক ও তার পরিবারের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতেও খুব অল্প সংখ্যক শিল্প মালিকই এগিয়ে এসেছেন। অথচ শ্রমিকদের দুপুরের খাবার, চিকিৎসা, ডে-কেয়ার সেন্টারসহ বিভিন্ন সেবা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করা গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে দেখা যায়, সেখানে মালিকদের মুনাফা কমেনি। বরং অসন্তোষ কম থাকায় উৎপাদন নির্বিঘ্ন হচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here