বাজেট ঘোষণার এক মাস আগে অনেকটা ঢিমেতালেই চলছিল পুঁজিবাজার। পুঁজিবাজারে ২২টি খাতের মধ্যে ব্যাংক, নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠান, প্রকৌশল, ওষুধ ও রসায়ন এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের আধিপত্যই ছিল বেশি। আর্থিক হিসাব (জুলাই-জুন) বছর ঘনিয়ে আসায় মৌলভিত্তির কিছু কম্পানি ছাড়া মন্দাবস্থায় ছিল বস্ত্র খাতের বেশির ভাগ কম্পানিই। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে পোশাকশিল্প খাতে করপোরেট কর অর্ধেক কমিয়ে দেওয়ায় গতি পেয়েছে পুঁজিবাজারের বস্ত্র খাত। বাজেট পাসের আগ পর্যন্ত মাসব্যাপী শীর্ষে ছিল এই খাত। গত বছরের জুন মাসের চেয়ে এবার লেনদেন দ্বিগুণ হয়েছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আর্থিক হিসাব বছর কাছাকাছি হলে কম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়ে। তিন প্রান্তিকের হিসাব পর্যালোচনা কিংবা বিশ্লেষণের পর চতুর্থ প্রান্তিকের হিসাব কষতে থাকে। হিসাব-নিকাশ শেষে কম্পানির ফান্ডামেন্টালস ও আর্থিক হিসাব দেখে লভ্যাংশ পাওয়ার আশায় শেয়ার কেনে। আবার কম্পানির নতুন কোনো ঘোষণায়ও শেয়ারের দাম বৃদ্ধি পায়। বাজেটে গার্মেন্ট খাতে করপোরেট কর হ্রাস হওয়ায় পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বস্ত্র খাতের কম্পানিগুলোর ৮ শতাংশ খরচ কমবে। এতে বাড়বে কম্পানির আয় ও মুনাফা। যার প্রভাব পড়বে শেয়ারের লভ্যাংশে।
ইতিমধ্যে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ৯ মাসে (জুলাই ’১৬-মার্চ ’১৭) পুঁজিবাজারে বস্ত্র খাতের সব কম্পানি তৃতীয় প্রান্তিকের হিসাব প্রকাশ করেছে। গত ৩০ জুন চতুর্থ প্রান্তিক বা হিসাব বছর শেষ হয়েছে। শিগগিরই আর্থিক হিসাব-নিকাশ শেষে লভ্যাংশ আসতে শুরু করবে।
কালের কণ্ঠের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বস্ত্র খাতের ৮৫ শতাংশ কম্পানি মুনাফা করেছে। এই সময়ে তালিকাভুক্ত ৪৮ কম্পানির মধ্যে ৪১টি মুনাফা করেছে। আর ৭টি কম্পানি মুনাফা করতে পারেনি। একটি কম্পানি এক প্রান্তিকে ক্ষতিতে থাকলেও পরবর্তী দুই প্রান্তিকে মুনাফায় ফিরেছে।
গত ৫ মে বস্ত্র খাতের আলটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ারের দাম ছিল ১১.৯ টাকা। বাজেট ঘোষণার পর থেকেই শেয়ারের দাম বাড়ছে। মাসব্যাপী হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে শেয়ারের দাম দাঁড়িয়েছে ১৫.২ টাকা। গত জুন মাস থেকে শেয়ারের দাম বাড়ছে ঢাকা ডায়িংয়ের। ১ জুন থেকেই শেয়ারের দাম বাড়ছে। এই সময়ে ৭ টাকা মূল্যের শেয়ার এখন ১০ টাকার কাছাকাছি। গত মে মাস থেকেই বাড়ছিল প্যারামাউন্ট টেক্সটাইলের শেয়ারের দাম। বাজেট ঘোষণার পর করপোরেট কর হ্রাস পেলে শেয়ারের দাম আরো বাড়তে থাকে। মে মাসে ২৭ টাকার শেয়ার দাঁড়িয়েছে ৩৯ টাকায়।
বাজেটে করপোরেট কর হ্রাসের ঘোষণায় সব খাতের কম্পানির শেয়ারের দাম ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। কোনো কোনো কম্পানির শেয়ারের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আবার কোনোটি ক্ষতির মধ্যে থাকলেও শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ার কারণ জানতে কম্পানিকে চিঠি দিয়েছে স্টক এক্সচেঞ্জ।
সূত্র জানায়, আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে গার্মেন্ট খাতে করপোরেট করে বড় ছাড় দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি উেস করেও ছাড় এসেছে। ১ জুন বাজেট ঘোষণার দিন গার্মেন্ট খাতের বিদ্যমান ২০ শতাংশ করপোরেট কর হ্রাস করে ১৫ শতাংশ প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। আর গ্রিনবিল্ডিং সনদপ্রাপ্ত পোশাক কারখানার জন্য ১৪ শতাংশ করপোরেট কর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। তবে বাজেট পাসের দিন এই প্রস্তাব আরো কমানো হয়েছে। গার্মেন্ট খাতের জন্য করপোরেট কর রাখা হয়েছে ১২ শতাংশ।
জানা গেছে, চলতি বছরের গত জুনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ২০ খাতে লেনদেন হয় ১০ হাজার ১৫৬ কোটি ৩৮ লাখ এক হাজার ৫৬৩ টাকা। যার মধ্যে শুধু বস্ত্র খাতে লেনদেন হয়েছে এক হাজার ৮৯৩ কোটি ৩৪ লাখ ৭৫ হাজার ৩৫৯ টাকা। অর্থাৎ মোট লেনদেনের ১৮.৬৪ শতাংশ। জুন মাসে বস্ত্র খাতেই সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। এমনকি মাসব্যাপী লেনদেনে প্রত্যেক দিনই শীর্ষে ছিল বস্ত্র খাত। মৌলভিত্তির ব্যাংক খাতের লেনদেন ছিল ১৪.৫২ শতাংশ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের ছিল ১০.০১ শতাংশ। আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লেনদেন হয় ১২.৪৫ শতাংশ।
গত মে মাসে ডিএসইতে লেনদেন ছিল ১২ হাজার ২৫৮ কোটি ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৮৫৪ টাকা। এতে বস্ত্র খাতের লেনদেন হয় এক হাজার ৭৮৮ কোটি ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬৫ টাকা। মোট লেনদেনের ১৪.৫৯ শতাংশ। ব্যাংক খাতের লেনদেন ১৩.৭৬, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১২.৬৭ ও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের লেনদেন ১৩.৪৮ শতাংশ। জুন মাসে বেশির ভাগ খাতেরই লেনদেন কমেছে। তবে বস্ত্র খাতের লেনদেন ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারে গার্মেন্ট খাতে করপোরেট কর ছাড় দেওয়ায় নতুন মাত্রা পেয়েছে বস্ত্র খাত। যদিও এক-দুই মাস আগেও মন্দাবস্থায় ছিল বস্ত্র খাত। করপোরেট কর কমলে কম্পানির মুনাফা বাড়বে। আর শেয়ারের বিপরীতে ভালো লভ্যাংশও পাবে শেয়ারগ্রাহকরা। এ ছাড়া আর্থিক হিসাব বছর শেষ হওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বস্ত্র খাতে।
ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে জানান, করপোরেট কর হ্রাস পাওয়ায় বস্ত্র খাতের কম্পানির দিকে ঝুঁকছে বিনিয়োগকারীরা। বাজেটে পোশাক খাতে করপোরেট কর হ্রাসের ঘোষণায় বস্ত্র খাতের কম্পানিতে হামলে পড়ে বিনিয়োগকারীরা। মৌলভিত্তি কিংবা দুর্বল যেকোনো কম্পানিতেই বিনিয়োগ করেছে। আবার কেউ কেউ অন্য কম্পানির শেয়ার ছেড়ে বস্ত্র খাতেই বিনিয়োগ করেছেন।
২০১৬ সালের জুন মাসের হিসাব পর্যালোচনায় দেখা গেছে, এ বছর ডিএসইতে বস্ত্র খাতের লেনদেন দ্বিগুণ হয়েছে। গত বছর জুনে লেনদেন হয়েছিল আট হাজার ১৩৪ কোটি ২৯ লাখ ৫১ হাজার ২৯৮ টাকা। এর মধ্যে বস্ত্র খাতে লেনদেন হয়েছিল ৭৬৩ কোটি ৩৭ লাখ ৯৫ হাজার ১০৩ টাকা, যা মোট লেনদেনের ৯.৩৮ শতাংশ। সেই হিসাবে এবার লেনদেন দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।