চট্টগ্রামে গত সাড়ে ৪ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ২৮৫ পোশাক শিল্প কারখানা। তবে অধিকাংশ কারখানা রপ্তানি আদেশের অভাবে বন্ধ করতে বাধ্য হয়। এছাড়া অবকাঠামোগত সমস্যা ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা ইস্যুতে বেশ কিছু কারখানায় ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকার পোশাক ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ ও অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি। অন্যদিকে গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যার কারণে প্রতিনিয়ত কারখানার উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। পোশাক কারখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত পাঁচ বছরে দুই দফায় শ্রমিকদের মজুরি ও বেতন খাতে ২২৩ শতাংশ ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কারখানার পরিচালন ব্যয় বেড়েছে ১৭ দশমিক ১১ শতাংশ। এছাড়া গ্যাস, বিদ্যুত ও জ্বালানি তেলের অব্যাহত মূল্য বৃদ্ধি তো রয়েছেই। কারখানা বন্ধ হওয়ায় রপ্তানি প্রবৃদ্ধিও কমেছে আশঙ্কাজনকভাবে। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে সক্ষমতার অভাবে নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য খালাস সম্ভব হচ্ছে না। তাই মালিকদের বাধ্য হয়েই বিমানে পণ্য আমদানি করতে হয়। এতে পরিবহন ব্যয় বাড়ছে দ্বিগুণ।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামে ছোট বড় মিলে ৬৭৬ টি পোশাক কারখানার মধ্যে বর্তমানে চালু আছে ৩৯১টি। তারমধ্যে আমদানি-রপ্তানি করছে ২৫০ টি, বাকি ১৪১ কারখানা সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করছে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্তপূরণ করতে না পারা ও রপ্তানি আদেশ সংকটে সাড়ে ৪ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ২৮৫ টি কারখানা। তারমধ্যে গত বছর বন্ধ হয় শতাধিক কারখানা। জানা গেছে, গত ২০১৪ সালে দেশের মোট রপ্তানির ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। এছাড়া ২০১৫ সালে সেটি দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং গত বছর রপ্তানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশে। অর্থাৎ গত তিন বছরে চট্টগ্রামের পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানি হয় ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক।
পোশাক কারখানা মালিকরা জানান, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক রপ্তানি খাতে উৎসে কর কর্তনের হার ১ শতাংশ করায় পোশাক শিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বেড়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বর্তমানে ডলার নেগোশিয়েট করতে হচ্ছে ৮০ টাকারও নিচে। গত ৫ বছর আগে ৮৫ টাকায় নেগোশিয়েট করা হতো। এরই মধ্যে ন্যূনতম মজুরি ও বেতন খাতে ব্যয় বেড়েছে ২২৩ শতাংশ। এছাড়া গত ১ মার্চ থেকে প্রতি ঘন মিটার গ্যাসের দাম ৭ দশমিক ২৪ টাকা বেড়েছে। এর আগে বিদ্যুতের ইউনিট মূল্যও গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়েছে। ফলে অনেকগুলো কারখানা মালিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে ঠিকতে না পেরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
এছাড়া পোশাক কারখানা মালিকরা অভিযোগ করেছেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স জোট কিছু অস্বাভাবিক শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এতে তারা মানছে না দেশের প্রচলিত আইন-কানুন। যেমন একটি কারখানার ভবন ইমারত বিধিমালা মেনে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অনুমতি সাপেক্ষে গড়ে উঠে। সে েতে্রও জোট দুটি তাদের নিজস্ব যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া শেষে তা বাতিল করে দেয়। এতে করে সম্পূর্ণ নতুন করে বিল্ডিং করতে গিয়ে প্রচুর আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হন মালিকরা। এতে কারখানার চলতি মূলধনেরও সংকট দেখা দেয়। যার ফলে বাজারে ঠিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরের স মতার অভাবে পণ্য খালাসে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত লেগে যায়। ত্ের বিশেষে কারখানা মালিকদের বিমানে পণ্য আমদানি করতে হচ্ছে। ফলে বাড়ছে ব্যয়। তবে বাজেটে পোশাক শিল্পের কর্পোরেট করের হার ১৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করায় কিছুটা ব্যয় সংকোচন হবে বলে তারা জানান
কারখানা মালিকদের অভিমত, দেশের মোট প্রবৃদ্ধির একটি বড় অংশই যোগান দেয় পোশাক শিল্পখাত। সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়ন করতে হলে দেশের মোট প্রবৃদ্ধি লাগবে ৮ শতাংশ। পোশাক শিল্পখাত এতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারবে। তাই পোশাক শিল্পে তারা সরকারি পৃষ্টপোষকতা চান। এছাড়া তারা পোশাক শিল্প খাতে সিঙ্গেল ডিজিটে ব্যাংক ঋণ দেয়ার দাবি জানান। জানা গেছে, বর্তমানে তৈরি পোশাকের বিশ্ব বাজার ৪৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০২১ সালে তা এসে দাঁড়াবে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারে। তবে কারখানা বন্ধ হওয়ার প্রভাবে গত অর্থবছরে পোশাক শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২ দশমিক ২১ শতাংশ।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মোহাম্মদ ফেরদৌস বলেন, চট্টগ্রামের সার্বিক পোশাক কারখানার পরিস্থিতি খুব নাজুক। কিছু বড় কারখানা বাদ দিলে ছোট খাট কারখানাগুলোতে অর্ডার নেই বললেই চলে। অনেকে কিছু কিছু সাব-কন্ট্রাক্ট্রে কাজ করে ঠিকে আছেন। এতে করে মালিকেরা খুব চাপে আছেন। চাপ নিতে না পেরেই মূলত দিনের পর দিন কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে । এর মধ্যে পোশাক ক্রেতারা চট্টগ্রামের বেশিরভাগ কারখানাগুলোর পরিবেশ বিবেচনায় খুব কম মূল্য প্রস্তাব করে। আগে যে শার্ট ডজন প্রতি ১২ ডলার দিতো, তা এখন দিচ্ছে মাত্র ৯ ডলার। আবার প্রতিদিন কারখানায় পরিচালন ব্যয় বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। অর্ডার সংকটের এ অবস্থা চলতে থাকলে ছোট খাটো অনেক কারখানা বন্ধের ঝুঁকিতে থাকবে। তারপরেও আমরা আশায় আছি, যদি পরিস্থিতির উন্নতি হয়।
তিনি আরো বলেন, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স জোটের শতভাগ রেটিং মেনে কাজ করতে গিয়ে প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এটিও মালিকদের ওপর চাপ হয়ে যায়। তাদের পহ্ম্যান বাস্তবায়ন করতে ৫ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। এর মধ্যে জ্বালানি, গ্যাস ও বিদ্যুতের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি হচ্ছে। এতে বাড়ছে উৎপাদন ব্যয়।
অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত অনেকগুলো কারখানা ইতিমধ্যে পূরণ করেছে উলেহ্মখ করে বিজিএমইএর পরিচালক এএনএম সাইফুদ্দিন বলেন, আগামী ২০১৮ সালে তাদের সাথে চুক্তি শেষ হচ্ছে। আশা করি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শতভাগ কারখানায় অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত নিশ্চিত করে কাজ চালানো সম্ভব হবে। তবে শুনেছি, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স আরো তিন বছরের জন্য চুক্তি বাড়াতে চায়। তাদের মতে, ২০১৮ সালেই ৯৪ শতাংশ কারখানা প্রস্তুত হবে। বাকি ৬ শতাংশের জন্য তিন বছরের চুক্তিবৃদ্ধির প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।
উলেহ্মখ্য, অ্যাকর্ড হলো, বিভিন্ন ব্র্যান্ড এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যে একটি আইনত বাধ্যতামূলক স্বতন্ত্র চুক্তি, যা নিরাপদ এবং সুস্থ বাংলাদেশি তৈরি পোশাক শিল্পের উদ্দেশ্যে করা হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো একটি কার্যকর পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে কোনো শ্রমিক আগুন লাগা, বিল্ডিং ধসে পড়া, বা অন্য কোনো দুর্ঘটনার ভয় পাবে না, যা উপযুক্ত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব। অন্যদিকে অ্যালায়েন্স শ্রমিক সংগঠন, কারখানার মালিক, এনজিও, সুশীল সমাজ, কারিগরি ও প্রকৌশল পরামর্শদাতা, শিল্প সংস্থা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কারিগরি মানসম্পন্ন এবং টেকসই নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কাজ করে যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত, রাজধানীর অদূরে সাভারের রানা প্লাজায় ২০১৩ সালে ভবন ধসে শ্রমিক মৃত্যু ও আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের অগ্নিকাণ্ডের (২০১২) পর অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর থেকেই ক্রেতারা মূলত অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নিশ্চিতে জোর দেন।
চট্টগ্রামে বন্ধ হয়েছে ৩৩৬টি গার্মেন্টস। আগামী দুই মাসের মধ্যে আইএলও, সরকার ও বিজিএমইএর ত্রিপক্ষীয় পরিদর্শন কাজ শুরু হলে ১৫৪৯টি গার্মেন্টস কারখানার অর্ধেকই বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে তৈরি পোশাকের বিশ্ব বাজার ৪৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ২০২১ সালে তা এসে দাঁড়াবে ৬৫০ বিলিয়ন ডলারে।
প্রসঙ্গত, বিশ্ববাজারে গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিতে ৩৯ শতাংশ অবদান চীনের। আর বাংলাদেশের মাত্র ৬ শতাংশ। কিন্তু উচ্চমূল্যের মজুরির কারণে ২০২১ সালে চীনের অবদান কমে ২০ শতাংশে দাঁড়াবে বলে এক গবেষণায় দেখা গেছে। আর চীনের হারানো এই ১৯ শতাংশ বাংলাদেশের জন্য বড় সুযোগ। যা কাজে লাগাতে এখনই উদ্যোগী বিজিএমইএ।