কথা ছিল ঈদের ছুটি শেষে আবারো কাজে যোগদান করার। কিন্তু ঈদের ছুটি শেষে কাজে যোগদান করতে এসে শ্রমিক ফারজানা দেখতে পায় তার কর্মস্থল এইচএসবি গার্মেন্ট হঠাৎ বন্ধ। জানতে পারে কোনো ধরনের আগাম নোটিশ ছাড়া গত ৪ জুলাই রাজধানীর মালিবাগের এইচএসবি গার্মেন্ট হঠাৎ বন্ধ করে দেয় মালিক পক্ষ।
ফারজানার চোখে মুখে অন্ধকার। কোথায় যাবে আবার কর্মের খোঁজে। শুধু ফারজানা নয় তার মতো প্রায় ১০ হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক বেকার হয়েছে গত একমাসে। একই সময়ে এইচ এসবি গার্মেন্টের মতো বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ২৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে. এইচএসবি কারখানায় কর্মরত ছিলেন প্রায় ৮শ শ্রমিক। ঈদের ছুটি শেষে কাজ করতে এসে কারখানা বন্ধ দেখে শ্রমিকদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই অজানা আতঙ্ক দেখা দেয়। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু এইচএসবি নয় বরং অন্যত্র কারখানা স্থানান্তর, উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়াসহ নানা কারণে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে চাকরি হারিয়ে অনিশ্চিত গন্তব্যের শঙ্কায় রয়েছেন এসব কারখানার লাখো শ্রমিক।
বন্ধ হয়ে যাওয়া এইচএসবি গার্মেন্টসের সুইং অপারেটর সুজন জানান, ‘এসএইচবি-১, এসএইচবি-২ ও এসএইচবি-৩ নামের তিনটি কারখানা বিনা নোটিশে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের বকেয়া বেতনও পরিশোধ করা হয়নি। এসব শ্রমিকরা এখন কোথায় যাবে?
এর আগে গত ৫ জুন একইভাবে বন্ধ করে দেয়া হয় মধ্য বাড্ডা এলাকার শামস গার্মেন্ট। কারখানাটিরও পাঁচ শতাধিক শ্রমিক গত ১১ জুলাই বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করেছিল একই দাবিতে। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) সূত্রে জানা গেছে, শুধু এইচএসবি আর শামস গার্মেন্ট নয় বরং মিরপুরে কিউ পয়েন্ট ও গাজীপুরে জীকন গার্মেন্টসহ গত এক মাসে প্রায় ২৫টির বেশি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, অগ্রিম নোটিস না দিয়ে কোনো কারণ ছাড়া হুটহাট করে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পোশাক শ্রমিকরা আতঙ্কে রয়েছেন। এক মাসেই ২৫টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আরো অনেক কারখানা বন্ধ হওয়ার পথে। এভাবে চলতে পারে না।
বিজিএমইএর একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেন, কারখানা বন্ধ হচ্ছে এর প্রমাণ আমরাও দেখছি। কারণ রমযান ঈদের আগে প্রায় প্রতিদিনই শ্রমিকরা বিজিএমইএ ভবন ঘেরাও করতে এসেছিল। বিভিন্ন সময় এটা নিয়ে দেন-দরবারও হয়েছে। বিষয়গুলো সমাধানের লক্ষ্যে বিজিএমইএ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাবমতে, ২৫টি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গত এক মাসেই বেকার হয়ে পড়ছেন কমপক্ষে ১০ হাজার শ্রমিক। এছাড়া জীকন গার্মেন্টসে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক ছিল। এসব শ্রমিকরা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
তবে বিনা নোটিশে মালিকদের কারখানা বন্ধের চেয়েও দুঃসংবাদ হচ্ছে, কারখানার সার্বিক উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ না করায় এবং এখনও প্রাথমিক পরিদর্শনের বাইরে রয়েছে এমন আরো কয়েক শ’ কারখানা বন্ধের চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। মূলধারার বাইরে থাকা যেসব কারখানার ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা মান যাচাই কার্যক্রম এখনও শুরু হয়নি সেগুলোও রয়েছে বন্ধের তালিকায়।
ডিআইএফই সূত্রে জানা গেছে, রানা প্লাজার ধসের পর গত চার বছরে পোশাক খাতের ব্যাপক সংস্কার অগ্রগতি সত্যেও ৮শ থেকে ৯শ কারখানায় সার্বিক উন্নয়ন ও সংস্কার কাজ হয়নি। এতগুলো কারখানা নজরদারির বাইরে থাকায় গোটা খাতের নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এছাড়া কারখানাগুলোকে পরিদর্শনের মাধ্যমে কমপ্লায়েন্সের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কাছে অর্থ সহায়তা চেয়ে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যায়নি।
সাবকন্ট্রাক্টের এসব কারখানায় অবকাঠামো দুর্বলতা ছাড়াও বেতন-ভাতা নিয়ে প্রায়ই অসন্তোষ দেখা যায়। গত ঈদে বেতন-ভাতা দিতে না পাওয়ার ঝুঁকিতে থাকা এগারোশ কারখানার একটি তালিকা বিজিএমইএ এবং সরকারের কাছে জমা দিয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। সার্বিক দিক বিবেচনা করে আর কিছু দিন সময় দিয়ে কারখানাগুলো আইনগতভাবে বন্ধ করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হবে।
ডিআইএফইর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আকারে ছোট এবং উৎপাদনে অনিয়মিত এসব কারখানা প্রতি গড়ে ২৫০ থেকে ৩০০ জন শ্রমিক কাজ করে। সে হিসেবে প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান রয়েছে এসব কারখানায়। যেগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা জেলায়। নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামেও কিছু কারখানা রয়েছে।
ডিআইএফই’র মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন,এসব কারখানা ভবনের কাঠামো, অগ্নি ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা মান যাচাইয়ের জন্য আইএলওর কাছে অর্থ সহায়তা চেয়েও পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, কারখানাগুলোকে বিনা ব্যয়ে পরিদর্শন করে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল। তারা সে সুযোগ কাজে লাগায়নি। তাই এবার শেষ দফায় কারখানাগুলোর মালিকদের সঙ্গে বসবে ডিআইএফই। এতে সন্তোষজনক অগ্রগতি না হলে নিরাপত্তার স্বার্থে কারখানাগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে বলে।
বিজিএমইএর পরিচালক শহিদুল হক মুকুল বলেন, সংস্কারের বাইরে থাকা কোনো পোশাক কারখানার বিরুদ্ধে সরকার আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলে আমাদের আপত্তি থাকবে না। তিনি বলেন, সাবকন্ট্রাক্টে কাজ করে এ ধরনের কারখানার অধিকাংশই ঢাকার কেরানিগঞ্জে। এগুলোকে একেবারে বন্ধ না করে সরকারি উদ্যোগে টিকিয়ে রাখলে পোশাক খাতের জন্য ভাল হবে। কারণ এরা পোশাকের অভ্যন্তরীন চাহিদা মেটায়। তাছাড়া এ ধরনের ছোট কারখানায় কিছু দক্ষতা অর্জন করে শ্রমিকরা উন্নতমানের কারখানায় কাজের সুযোগ পায়। এছাড়া অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শ্রমিকদের বেকারত্বের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা দরকার।