দেশের তৈরী পোশাকের বড় আমদানিকারক ৯টি দেশের মধ্যে পাঁচটিতেই ১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ২৬ শতাংশ ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে দেশের রফতানি আয়ে তৈরী পোশাক খাতের অবদান কমে গেছে। বিদায়ী অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের রফতানি আয়ের প্রায় ৭৮ দশমিক ৯২ শতাংশ অবদান ছিল তৈরী পোশাক খাতের। যেখানে আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৫ শতাংশ। তৈরী পোশাক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তৈরী পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, রফতানিকারকদের যে প্রাইস সক্ষমতা কমে গেছে তার অন্যতম প্রমাণ হলো এ রফতানি প্রবৃদ্ধি। তারা আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি উন্নত করার বাস্তব পদক্ষেপ না নিলে এ খাতে আরো ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়াবে, যার ফলে দেশের বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের বড় বাজার ইউরোপীয় ৯টি দেশ। এর মধ্যে পাঁচটি দেশই বাংলাদেশের তৈরী পোশাক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বিদায়ী অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে ৯ দেশের মধ্যে পাঁচ দেশেই সর্বনি¤œ ১ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, বেলজিয়াম ও কানাডা রয়েছে। সবচেয়ে বেশি কমেছে বেলজিয়ামে। দেশটি আগের গত অর্থবছরের (২০১৫-১৬) তৃতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক আমদানি করেছিল ২২ কোটি ৬৫ লাখ ডলারের। বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৬-১৭) একই সময়ে তা কমে নেমেছে ১৬ কোটি ৬৮ লাখ ডলারে। এক বছরের ব্যবধানে তিন মাসে দেশটির আমদানি কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের আরেক বড় বাজার যুক্তরাজ্য। দেশটি গত বছরে তৃতীয় প্রান্তিকে বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক আমদানি করেছিল ৯৮ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের। কিন্তু বিদায়ী অর্থবছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে ৮৯ কোটি ৩১ লাখ ডলারে। অর্থ্যাৎ এক বছরের ব্যবধানে তা কমেছে প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ।
বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এ যুক্তরাষ্ট্রেও গত এক বছরে তৈরী পোশাক রফতানি সাড়ে চার শতাংশ কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি হয়েছিল ১৩৩ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য। চলতি বছরের একই সময়ে তা না বেড়ে বরং কমে নেমেছে ১২৮ কোটি ডলারে।
যুক্তরাষ্ট্রের মতো কানাডায়ও তিন মাসে রফতানি আয় কমেছে ৫ দশমিক ২১ শতাংশ। গত বছরের প্রথম তিন মাসে কানাডায় তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছিল ২৪ কোটি ৬৬ লাখ ডলারের, চলতি বছরের একই সময়ে তা কমে নেমেছে ২৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলারে। এদিকে স্পেনেও আলোচ্য সময়ে তৈরী পোশাক রফতানি ৪৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার থেকে কমে নেমেছে ৪৯ কোটি ২২ লাখ ডলারে।
বড় ৯ দেশের মধ্যে চার দেশ যথা জার্মানিতে ৮ শতাংশ, ফ্রান্সে আড়াই শতাংশ, ইতালিতে প্রায় ৬ শতাংশ এবং নেদারল্যান্ডে ২০ শতাংশ তৈরী পোশাক খাতের রফতানি বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত বছরের প্রথম তিন মাসে ৮৮৭ কোটি ১৩ লাখ ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছিল। এর মধ্যে তৈরী পোশাক খাতেরই ছিল ৭৫০ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের। যা মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশে রফতানি হয়েছিল ৯১৪ কোটি ৭৯ লাখ ডলারের পণ্য। এর মধ্যে তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে ৭২১ কোটি ৯১ লাখ ডলারের। যা মোট রফতানি আয়ের ৭৮ দশমিক ৯২ শতাংশ।
এ বিষয়ে তৈরী পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও বাংলাদেশ এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিইএ) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, নানা কারণে তৈরী পোশাক খাতে রফতানি কমে যাচ্ছে। তিনি জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমে যাচ্ছে। অব্যাহতভাবে কমে যাচ্ছে পণ্যের দরপত্র। অন্য দিকে, আন্তর্জাতিক নানা নীতির সাথে রফতানি আয় ঠিক রাখতে প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের অভ্যন্তরে সমন্বয় করছে। যেমন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার সাথে সাথে প্রতিযোগী দেশগুলোও তাদের দেশে তা সমন্বয় করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে তা সমন্বয় করা হয়নি। বিপরীতে গত দুই বছরে শ্রমিকের মজুরি, জ্বালানি ও পরিবহন ভাড়াসহ তৈরী পোশাক খাতের ব্যয় বেড়েছে ১৮ শতাংশ। অন্য দিকে বাধ্যতামূলকভাবে রাজধানী থেকে কারখানা সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে। ফলে দেশের তৈরী পোশাক খাতের রফতানিকারকদের প্রাইস সক্ষমতা কমে গেছে। এরই প্রতিফলন ঘটেছে সামগ্রিক রফতানিতে। তিনি জানান, প্রাইস সক্ষমতা বাড়াতে হলে রফতানিমুখী শিল্পে কোনোভাবেই করের বোঝা বাড়ানো যাবে না। নীতি সহায়তা বাড়াতে হবে। দিতে হবে বিশেষ প্রণোদনা। যেসব তৈরী পোশাক কারখানা ঢাকার বাইরে নিতে হচ্ছে ওই সব উদ্যোক্তাদের কারখানায় নিরবচ্ছিন্নভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ দিতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদেরও একই সুবিধা দিতে হবে। আর তবেই গত দশ বছর ধরে তৈরী পোশাক খাতের যে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ছিল তা বজায় রাখা সম্ভব হবে। অন্যথায় দেশে বেকারত্বের হার আরো বেড়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন।