বাংলাদেশের পোশাক খাতের ‘খবরদারি’তে নিয়োজিত দু’প্রতিষ্ঠান অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অতিরিক্ত মেয়াদে থাকা না থাকা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় নীতিনির্ধারকরা। এ দোদুল্যমানতা কাটাতে সাধারণ পোশাক শিল্পোদ্যোক্তাদের মতামত জানতে চায় তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন (বিজিএমইএ)। এ লক্ষ্যে ৩০ জুলাই নিজস্ব মিলনায়তনে সংগঠনের বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ডাকা হয়েছে। সভায় নতুন ভার্সনে ইইউ ব্র্যান্ডের ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্র্যান্ড ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্সের অতিরিক্ত মেয়াদে বাংলাদেশে অবস্থানকে কিভাবে দেখছেন সে বিষয়ে সাধারণ সদস্যদের বক্তব্য শুনবেন নেতারা। এর ওপর ভিত্তি করে বিজিএমইএ পরে কর্মকৌশল ঠিক করার পর তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানিয়ে দেয়া হবে।
সূত্র বলছে, ইতিমধ্যে বিজিএমইএ বিশেষ সাধারণ সভায় সদস্যদের আমন্ত্রণ জানিয়ে সংগঠনের প্রায় ৩ হাজার ৭০০ সদস্য প্রতিষ্ঠানকে ই-মেইল করা হয়েছে।
অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের অতিরিক্ত মেয়াদে অবস্থানের আগ্রহ প্রকাশ সম্পর্কে জানতে চাইলে রোববার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘তারা তাদের কাজ করেছে। এখন আমরা কী করব সেটাই দেখার বিষয়। অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, আগে তাদের বৈধ মেয়াদের সীমা শেষ হোক। তারপর সময়োচিত সিদ্ধান্ত নেবে সরকার। সে সিদ্ধান্তে সব কূলই রক্ষা হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার পর থেকেই সরকার ও মালিকপক্ষের মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতা দেখা দেয়। পোশাক কারখানার কমপ্লায়েন্স তদারকির সঙ্গে কারখানার বয়লার পরিস্থিতিও নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণের খায়েশই গার্মেন্ট মালিকদের শঙ্কিত করেছে। দু’ক্রেতা জোটের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিজিএমইএকে জানানো হয়েছে। কিন্তু পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর নেতাদের কেউই এ ক্রেতা জোটকে সরাসরি না বলতে পারছেন না। আবার তারা হজমও করতে পারছেন না। একই অবস্থা সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও। পরিস্থিতি সামাল দিতেই এ বিশেষ সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে।
বাংলাদেশে এ দু’সংস্থার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে চাইলে মালিকপক্ষের সমন্বয়ক ও বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মো. মাহমুদ হাসান খান যুগান্তরকে বলেন, সাধারণ সদস্যদের কথা ভেবেই ইজিএম ডাকা হয়েছে। সভার আলোচনা থেকে আমরা তাদের কমপ্লায়েন্স কার্যক্রমের অগ্রগতি ও বাকি কাজ শেষ করার সময়সীমা সম্পর্কে অবহিত হতে পারব। এর ফলে সবার প্রকৃত অবস্থান জানা সম্ভব হবে এবং আমাদেরও (বিজিএমইএর) সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হবে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ক্রেতা জোটের থাকা না থাকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর স্বার্থে এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে আমাদের কমপ্লায়েন্ট হতে হবে। কিন্তু এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ভবিষ্যতে দেশে আরও নতুন শিল্প আসবে। তারা কিভাবে কমপ্লায়েন্ট হবে বা কতটা হল সেটি দেখভালের জন্য একটি কর্তৃপক্ষ দরকার। সেটা দেশে সরকারিভাবে হতে পারে। অথবা সরকার ও আইএলওর সমন্বয়েও হতে পারে। ওই প্রক্রিয়ায় কারা থাকবে না থাকবে সেটা উইন উইন সিচুয়েশনে আলোচনার ভিত্তিতেই সরকার ঠিক করবে। সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সকে বাংলাদেশে ৫ বছরের জন্য নিবন্ধন দেয়। ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা পরবর্তী সংকট কাটাতে ত্রিপক্ষীয় সমঝোতার ভিত্তিতে এ অনুমোদন দেয়া হয়। যার মেয়াদ ২০১৮ সালের ৩১ মে শেষ হবে। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ইউরোপীয় পার্লামেন্ট (ইপি) অ্যাকর্ডকে বাংলাদেশে আরও ৩ বছর কর্মকাণ্ড চালানোর অনুমোদন দেয়। অ্যালায়েন্সও একই পথে হাঁটছে। ওদিকে বিশ্বে পোশাক সরবরাহে মাত্র ৬ শতাংশ অবদান রাখছে বাংলাদেশ। চাহিদার বাকি ৯৪ শতাংশ সরবরাহ করছে অন্য পোশাক উৎপাদনকারী দেশ। কিন্তু সেসব দেশে অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের তৎপরতা নেই। এ নিয়ে উদ্যোক্তারা চরম ক্ষুব্ধ। ফলে শিল্প মালিকরা সরকারকে নিয়ে খুব শিগগিরই আইএলওর মাধ্যমে ব্র্যান্ড বায়ারদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন বলেও জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক ও বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, সংস্কার কাজ শেষ না হলে অতিরিক্ত সময় হয়তো প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে চুক্তি স্বাক্ষরকারী পক্ষগুলোই ঠিক করবে কিভাবে কী করতে হবে। তবে অতিরিক্ত ৩ বছর বাড়ানোটা যৌক্তিক নয়। এ নিয়ে সাধারণ সদস্যরা মতামত দিলে নেতাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহজ হবে। তবে শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই বলেছেন, সংস্কারের নামে দু’ক্রেতা জোটের অতিরিক্ত ৩ বছর খবরদারির প্রস্তাব মানবেন না তারা। তাদের বাড়তি সময় থেকে যাওয়ার যে খায়েশকে অনেকে ‘মামার বাড়ির আবদার’-এর সঙ্গেও তুলনা করেছেন। কয়েকজন গার্মেন্ট মালিকের অভিযোগ, দু’ক্রেতা জোট ইতিমধ্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এদের নানামুখী শর্তের বেড়াজালে অসংখ্য পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের খবরদারির আরও সুযোগ দেয়া হলে পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।