বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের দাম কমায় শঙ্কিত ব্যবসায়ীরা। আসন্ন ঈদুল আযহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। যদিও এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ মূল্য বাড়ানো হয়নি। গত তিন বছর ধরে চামড়ার সংগ্রহ মূল্য একই রাখা হয়েছে। ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫০ থেকে ৫৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৫ টাকা। এছাড়া সারা দেশে প্রতি বর্গফুট খাসির চামড়া হবে ২০ থেকে ২২ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৫ থেকে ১৭ টাকা।
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছেন, চামড়াশিল্প সাভারে স্থানান্তরের পর মালিকেরা একটু চাপে রয়েছেন। এ কারণে ভারতে বা অন্য দেশে দাম একটু বেশি হলেও গতবারের দামই রেখেছি। বাংলাদেশের রফতানি আয়ের দিক দিয়ে কাঁচা চামড়া তৃতীয় স্থানে রয়েছে। দেশে প্রস্তুতকৃত চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রায় ৯৫ ভাগই বিদেশে রফতানি হয়। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বিশ্ববাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের দাম কমেছে। বাংলাদেশের যেসব দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে সেখানেই দাম কমেছে ২০ শতাংশ। ফলে দেশীয় বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফিনিশ্ড লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি হাজী মোহাম্মদ বেলাল হোসেন বলেন, আমাদের কাঁচা চামড়ার সিংহভাগই আসে ঈদুল আযহার সময়। আর এখন বিশ্ববাজারে চামড়ার দাম কম। এই প্রভাব আমাদের বাজারে পড়বে। তিনি বলেন, গত দুই মাসে ৩০ থেকে ৪০ লাখ বর্গফুট কাঁচা চামড়ার এলসি বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা আমাদের চামড়া শিল্পের পরিবেশগত কারণ দেখিয়ে এই ঋণপত্র (এলসি) বাতিল করে। এটা এ ব্যবসার জন্য বড় ধরনের হুমকি।
বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএলএলএফইএ) সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ এবং ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেছেন, সাভারে চামড়া শিল্পনগরীতে স্থানান্তরের ফলে ব্যাংকঋণ পেতে সমস্যা হচ্ছে। তবে বাণিজ্যমন্ত্রী এ সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন বলে তারা জানান। ব্যবসায়ীরা জানান, বিশ্ববাজারে চামড়ার চাহিদা কমে যাওয়ায় গত রমজানের ঈদে যেসব চামড়া স্টকে রাখা ছিলো তা এখনো বিক্রি হয়নি। তাই এবারের কোরবানির ঈদে চামড়া বাজার নিয়ে তারা শঙ্কায় রয়েছেন।
বাংলাদেশে প্রতিবছর এক কোটি ৬৫ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে ছাগলের চামড়া এক কোটি, গরু ৫০ লাখ, ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ পিস। সবমিলিয়ে প্রায় ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া পাওয়া যায়। আর এই চামড়ার প্রায় অর্ধেকই কোরবানির ঈদে সংগ্রহ করা হয়। এদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি আয় বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে সুখবর এসেছে। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে দেখা যায়, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হয়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো’র (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যে ১১ কোটি ৬৭ লাখ ডলার রপ্তানি আয় হয়েছে। যা গতবছরের জুলাইয়ে অর্জিত আয়ের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। গতবছরের জুলাইয়ে ৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার রপ্তানি আয় হয়।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানোর জন্য নতুন নতুন বাজার খুঁজছেন উদ্যোক্তারা। এরই অংশ হিসেবে আগামী নভেম্বরে ঢাকায় আন্তর্জাতিক চামড়াজাত পণ্যের মেলার আয়োজন করেছে বাংলাদেশ পাকা চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি। এতে ১৬টি দেশ অংশ নেবে বলে জানা গেছে। বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বড় বাজার ইতালি। এরপরই রয়েছে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা, কানাডা, স্পেন, ফ্রান্স। এর বাইরে সমপ্রতি জাপান, জার্মানি, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডে সীমিত আকারে রপ্তানি হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিযোগী দেশ হচ্ছে চীন, ভারত ও পাকিস্তান। বাংলাদেশের তুলনায় এসব দেশের পণ্যের দাম কম হওয়ার কারণে ক্রেতারা ওইসব দেশের পণ্যের দিকে ঝুঁকছেন। ইপিবি’র তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ১২৫ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪০ কোটি ডলারে। যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, চামড়াজাত পণ্য পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিশ্বব্যাপী দিনদিন এর চাহিদা বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে ফিনিশড চামড়ার পাশাপাশি জুতা, ট্রাভেল ব্যাগ, বেল্ট, মানিব্যাগ, জ্যাকেট, চাবির রিং, কার্ড হোল্ডার রপ্তানি হচ্ছে। বিএফএলএলএফইএ’র সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ মাহিন বলেন, রপ্তানি বাড়াতে আমরা নতুন নতুন বাজার খুঁজছি। গত ২০ আগস্ট সচিবালয়ে কোরবানির পশুর দর নির্ধারণ সংক্রান্ত এক বৈঠক শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, চামড়াকে ইয়ার অব দ্য প্রোডাক্ট ঘোষণা করা হয়েছে। এ কারণে চামড়া খাতকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্য রফতানি করে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। কিন্তু ট্যানারি শিল্প হাজারিবাগ থেকে সাভারে স্থানান্তরের জটিলতায় সেটি হবে না। তবে আশা করছি, অন্তত ৩ বিলিয়ন ডলার আয় করবো।