পোশাকশিল্প খাতে ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের বিশাল মার্কেট ধরতে আটঘাট বেঁধেই নামছে ভারত। এ জন্য সরকারি পর্যায়ে যেমন ৬ হাজার কোটি রুপির প্রণোদনা প্যাকেজ নেওয়া হয়েছে তেমনি উদ্যোক্তাদেরও লক্ষ্য ঠিক করে দিচ্ছে ভারত সরকার। ২০১৮ সালে ২০ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রাকে ২০২৫ সালেই ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে চায় তারা। আর এমনটি হলে বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বাংলাদেশের জন্য আগামী কয়েক বছরেই সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হবে আশঙ্কা করছেন এই খাতসংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, নানা প্রতিকূলতার পরও ২০১৬ সালে তৈরি পোশাক খাতে বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। এবারও শীর্ষ রপ্তানিকারক দেশ চীনের পরই অবস্থান। ২০১৬ সালে চীনের রপ্তানি আয় কিছুটা কমলেও দেশটি ১৬১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি করে শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। তবে এ আয় আগের বছরের চেয়ে ৭ শতাংশ কম। অন্যদিকে ৬ শতাংশ বেড়ে বাংলাদেশ এ সময় আয় করেছে ২৮ বিলিয়ন ডলার। মোট রপ্তানিতেও চীনের অংশ ৩৬.৪ শতাংশ। মোট পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬.৪ শতাংশ।
শীর্ষ দশে বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভিয়েতনাম। দেশটি গত বছর ২৫ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। তাদের রপ্তানি বেড়েছে ৫ শতাংশ। মোট বাজারে ভিয়েতনামের অংশ ৫.৫ শতাংশ। চতুর্থ অবস্থানে থাকা ভারত রপ্তানি করেছে ১৮ বিলিয়ন ডলারের পোশাক। বিশ্ব রপ্তানিতে ভারতের অংশ ৪ শতাংশ।
২০১৮ সালের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে ভারতের রপ্তানি ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করছেন ভারতের পোশাক প্রস্তুতকারক অ্যাসোসিয়েশন (সিএমএআই) সভাপতি রাহুল মেহতা। সম্প্রতি ভারতের ইকোনমিক টাইমসের এক রিপোর্টে তিনি বলেন, ‘২০১৭ অর্থবছরে আমরা ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করছি। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ অর্থবছরে ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে ২০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। ’
প্রতিবেদনে তিনি বলেন, ‘যদিও বিশ্বমন্দা এবং চীন, বাংলাদেশ ও ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তবে সর্বশেষ ৫-৬ মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ১৩ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এ জন্য ২০১৬ সালের জুলাই মাসে অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রিতে সরকার ঘোষিত বিশেষ প্যাকেজই মূল ভূমিকা রেখেছে। ’
জানা গেছে, এই প্যাকেজের আওতায় টেক্সটাইল এবং অ্যাপারেল খাতের জন্য ৬ হাজার কোটি রুপি অনুমোদন করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। উদ্দেশ্য হিসেবে আগামী তিন বছরে এ খাতে এক কোটি নতুন কর্মসংস্থান এবং ১১ বিলিয়ন ডলার নতুন বিনিয়োগ এবং রপ্তানি এই সময়ে ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর থেকে এই প্যাকেজের অর্থও ছাড় দেওয়া শুরু করেছে সরকার।
গত ২ জুলাই ভারতের গুজরাটে অনুষ্ঠিত ‘টেক্সটাইল ইন্ডিয়া ২০১৭’ নামে তিন দিনব্যাপী এক মেলায় টেক্সটাইল খাতে দেশটির বড় ধরনের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরেন। আগামী ২০২৫ সালে টেক্সটাইল শিল্পে ৫০০ বিলিয়ন ডলারের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে চায়। এ সময় স্থানীয় বাজারে ৩১৫ বিলিয়ন ডলার এবং বাকি ১৮৫ বিলিয়ন ডলার আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি থেকে অর্জন করবে। এই দুই বাজারে বর্তমানে যথাক্রমে ৬৮ বিলিয়ন ডলার ও ৪১ বিলিয়ন ডলারের দখল আছে ভারতের। যদিও টেক্সটাইল খাতে বাংলাদেশের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে আছে প্রতিবেশী ভারত।
আরএমজি খাত ভারতের প্রাধান্য বিস্তারের প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি ও ইস্টার্ন অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাছির উদ্দিন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারত কিভাবে এগিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে একটা তুলনা দিলেই বোঝা যাবে। ভারত ২০২৫ সাল নাগাদ ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি পরিকল্পনা করেছে। এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় রোডম্যাপও তারা করে ফেলেছে। আর আমরা মাত্র ৩ বছর আগে ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। কিন্তু এখনো কোনো রোডম্যাপ তৈরি করিনি। এ বছরেই সেই লক্ষ্যে বিশাল ধাক্কা খেয়েছি আমরা। ’
তিনি বলেন, ‘ভারত ইতিমধ্যে ডলারের বিপরীতে রুপির অবমূল্যায়ন করেছে, অথচ আমাদের টাকা এখনো শক্তিশালী অবস্থানে। তাদের নিজেদের তুলা আছে। এ কারণে লিড টাইমেও তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে থাকবে। তারা যে লক্ষ্যে এগোচ্ছে তা খুব দ্রুততম সময়ে বাস্তবায়ন হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ’
বাংলাদেশ থেকে ‘টেক্সটাইল ইন্ডিয়া ২০১৭’ মেলায় অংশ নেওয়া বিজিএমইএ পরিচালক সাইফ উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারতের মূল লক্ষ্যই এখন পোশাকশিল্পে বাংলাদেশকে টপকানো। এ জন্য যা যা করা দরকার সরকার সেই উদ্যোগ গ্রহণ করছে। আমাদের কাছ থেকে তারা বারবার জানতে চাচ্ছে পোশাকশিল্পে আমাদের পলিসি কী। ’
তবে এখনই ভারত বাংলাদেশকে তৈরি পোশাকশিল্পে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারবে না বলে মনে করেন বিজিএমইএর আরেক সাবেক প্রথম সহসভাপতি এবং ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম, বাংলাদেশ, চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি আবু তৈয়ব। তিনি বলেন, ‘ভারত সরকার যে বিশাল প্রণোদনা দেওয়া শুরু করেছে তাতে হয়তো বাংলাদেশের পোশাকশিল্প কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তবে এখনই ভারত বাংলাদেশের সমপর্যায়ে আসতে পারবে না। তারচেয়ে ভিয়েতনাম যদি আগামী ২-৩ বছরের মধ্যে আমাদের পেছনে ফেলে তাতে আমি আশ্চর্য হব না। ’
ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ভারতে উৎপাদন খরচ বাংলাদেশ থেকে বেশি। শ্রমের মূল্য বেশি সেখানে। শ্রমঘন শিল্পে ভারত এখনো উপযোগী না, বরং প্রযুক্তিনির্ভর শিল্পে তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে। তবে এ নিয়ে আমাদের আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। সরকারকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা কিভাবে এগোচ্ছে আর আমরা কী ব্যবস্থা নিচ্ছি সেটা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। সরকারকেও সে অনুযায়ী সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ’