দুই বছর আগে প্রকারভেদে এক কেজি সুতার গড় উৎপাদন ব্যয় ছিল ২ ডলার ৬০ সেন্ট। গত বছর সেপ্টেম্বরে গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণে ব্যয় বেড়ে হয় ২ ডলার ৮৫ সেন্ট। চলতি বছরে গত মার্চ এবং জুনে দাম বাড়ানোর পর উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ ডলার ৩০ সেন্ট। তৈরি পোশাক উৎপাদনে প্রধান কাঁচামাল হিসেবে সুতা ব্যবহার হয়ে থাকে। বাস্তবতা হচ্ছে, প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মাত্র ১ সেন্টের ব্যবধানই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেন ক্রেতারা। এই দরের কারণে চাহিদা কমেছে দেশি বস্ত্র খাতের। ভালুকায় অবস্থিত মেট্রো স্পিনিং মিলে গতকাল পর্যন্ত অবিক্রীত সুতার পরিমাণ ৯০০ টন। মিলের এমডি মোহাম্মদ আলী খোকন সমকালকে জানান, গোডাউনে বিশাল পরিমাণ সুতা নিয়ে বিপদে আছেন তিনি। তার হিসাবে এই পরিমাণ সুতার মূল্য বাবদ ৩০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। জ্বালানি ব্যয় অনেক বেড়ে যাওয়ায় বস্ত্র খাতের সংকট আরও বেড়েছে।
সুতা ও বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) সূত্রে জানা গেছে, সমিতির সদস্য প্রায় সব স্পিনিং কারখানায় বিপুল পরিমাণ সুতা অবিক্রীত পড়ে আছে। দেশে বর্তমানে স্পিনিং মিলের সংখ্যা ৮৩০। বর্তমানে ফেব্রিক্স কারখানা ৭৯৪ ও ডায়িং কারখানার সংখ্যা ২৪১। এসব কারখানার প্রধান জ্বালানি হচ্ছে গ্যাস।
উদ্যোক্তারা শিল্প কারখানায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহূত ক্যাপটিভ পাওয়ারে গত দুই বছরে তিন দফায় গ্যাসের মূল্য ২২২ শতাংশ বাড়ানোর ফলে বছরে গড়ে ২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত গুনতে হয়েছে বস্ত্র খাতের মিলগুলোকে। তারপরও নতুন ক্যাপটিভে গ্যাস সংযোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। গ্যাসের সংকট কাটাতে এলএনজি আমদানি করছে সরকার।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং বিটিএমএ সভাপতি তপন চৌধুরী সমকালকে বলেন, এলএনজির দাম কত নির্ধারণ করা হবে তা এখনও জানা যায়নি। শোনা যাচ্ছে বর্তমান দামের দ্বিগুণ করা হবে। এ হারে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে এবার বস্ত্রকলগুলো নির্ঘাত বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ, বড় আকারের স্পিনিং, উইভিং, ডায়িং ও প্রিন্টিং-ফিনিশিং খাতে তুলা আর গ্যাসই শেষ কথা। একটি বস্ত্রকলের ২৫ শতাংশই বিনিয়োগ হয় গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ পাওয়ারে। সর্বশেষ দাম বাড়ানোর ফলে ক্যাপটিভে গ্যাসের দর এখন ঘনমিটার প্রতি ৯ টাকা ৬২ পয়সা। এতে তার কারখানাকে অতিরিক্ত ২২ কোটি টাকা গুনতে হয়েছে। তার মতে, বস্ত্র খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকও সংকটে পড়বে। পোশাকের কাঁচামালের দেশি উৎস বন্ধ হয়ে গেলে তুলা, সুতা এবং কাপড়ের দর বাড়িয়ে দিলে পোশাক খাতও প্রতিযোগিতামূলক দর থেকে ছিটকে পড়বে।
তিনি বলেন, সরকারের সহযোগিতায় গত প্রায় দুই দশকে পোশাক খাতের পশ্চাৎসংযোগ শিল্প শক্তিশালী হয়েছে। তবে গত বছর বস্ত্র ও পোশাক খাতের সহযোগিতায় প্রণোদনা বাড়িয়ে আরও ছয় হাজার কোটি রুপি অনুমোদন করেছে ভারত। নিজস্ব তুুলাসহ অন্যান্য কাঁচামাল এবং মূলধনী যন্ত্রপাতি মিলিয়ে ভারত শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্থানীয় সুতার কাপড়ের দর বেশি হওয়ায় পোশাক ক্রেতারা কম দামের ভারতীয় সুতা ব্যবহার করতে বলছেন। এতে মার খাচ্ছে দেশের বস্ত্র কারখানাগুলো।
রফতানিমুখী তৈরি পোশাকের প্রধান কাঁচামাল সুতা এবং কাপড়ের মোট চাহিদার বড় একটা সরবরাহ করে থাকে বস্ত্রকলগুলো। রফতানিমুখী পোশাকের বাইরে দেশি শাড়ি, লুঙ্গি এবং অন্যান্য সব কাপড়ের জোগান দিচ্ছে দেশি বস্ত্রকলগুলো। এ ছাড়া কিছু পরিমাণে সুতা এবং কাপড় সরাসরি রফতানি হয়ে থাকে।
বিটিএমএর সাবেক সভাপতি জাহাঙ্গীর আলামিন সমকালকে বলেন, গ্যাস সংকটের আপাতত একটা বিকল্প হতে পারে ফার্নেস অয়েল। কিন্তু বিদ্যমান দরে সেটা সম্ভব নয়। লিটার প্রতি ফার্নেস অয়েলের দাম এখন ৪২ টাকা। সরকার যদি শিল্প পরিচালনার জন্য শুল্ক্কমুক্ত ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেয় তাহলে আপাতত একটা সমাধান হতে পারে। বিশ্ববাজারের তুলনায় দেশে ফার্নেস অয়েলসহ সব ধরনের জ্বালানির দাম বেশি করে রাখা হয়েছে। দুই দশক আগে শিল্প কারখানা অন্যান্য কাঁচামালের মতো ফার্নেস অয়েলও শুল্ক্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি সুবিধা পেত।
জানা গেছে, বিষয়গুলো বিস্তারিত উল্লেখ করে সম্প্রতি জ্বালানিমন্ত্রী, উপদেষ্টা, সচিব এবং তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছেন বিটিএমএ নেতারা। তার আগে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। এতে আপাতত শুল্ক্কমুক্ত ফার্নেস অয়েল আমদানির সুবিধা দেওয়ার বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে।