বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামে ক্রমেই কমছে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগ। যাদের একাধিক প্রতিষ্ঠান ছিল, তারাও ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। এই শিল্পে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, তৈরি পোশাকশিল্প ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে ঢাকা অঞ্চলে। এখানে গ্যাস, বিদ্যুতের অভাবে কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই শিল্পে বিনিয়োগ করার সাহস পাচ্ছেন না উদ্যোক্তরা। অথচ বন্দর-সুবিধার কারণে বাংলাদেশে আশির দশকে প্রথম তৈরি পোশাকশিল্পের পথচলা চট্টগ্রাম দিয়েই শুরু হয়েছিল।
চিটাগাং মেট্রোপলিটন চেম্বারের সহসভাপতি ও বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক এএম মাহাবুব চৌধুরী আমাদের সময়কে জানান, বন্দরখরচ, বিদ্যুৎখরচ, জায়গার বাড়তি দাম। সে সঙ্গে শ্রমিকদের মজুরিও বাড়ছে। বিনিয়োগকারীরা লোকসানে পড়ার আশঙ্কায় এই শিল্পে বিনিয়োগ করছেন না। যারা একবার বিনিয়োগ করেছেন, তারা দ্বিতীয়বার এই শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছেন না। ফলে এই শিল্পে সংকট দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে নিবন্ধিত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জানুয়ারি থেকে জুন ২০১৭-এর তথ্যে দেখা যায়, গত ছয় মাসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করেছে মাত্র দুই প্রতিষ্ঠান। ফেব্রুয়ারি মাসে বন্দর থানার গোসাইলডাঙ্গা বারিক বিল্ডিং এলাকায় তাওয়াফ প্যাকেজিং অ্যান্ড এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করে ৫ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এই প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ জনের। আর মে মাসে পাহাড়তলীর দক্ষিণ কাটলী এলাকায় গার্মেন্টস এক্সেসরিজ খাতে নামিরাহ ট্রিম অ্যান্ড প্যাকেজিং লিমিটেড বিনিয়োগ করে দুই কোটি ১১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। এতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৪ জনের। দুই প্রতিষ্ঠানের মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ৭ কোটি ৮১ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। কর্মসংস্থান হয়েছে ৯৫ জনের।
অথচ একই সময়ে ২০১৬ সালে তৈরি পোশাক খাতে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করিয়েছিল ৭৩ প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগ হয়েছিল ১ হাজার ১৫৯ কোটি ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। আর এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬ হাজার ৯১২ জনের। ২০১৫ সালে তৈরি পোশাক খাতে চট্টগ্রামে বিনিয়োগের জন্য নিবন্ধন করিয়েছে ৬২ প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগ হয়েছিল ৩৪৮ কোটি ৪ লাখ ৬৯৭ হাজার টাকা। কর্মসংস্থান হয়েছে ৪ হাজার ৮৩৭ জনের। বিনিয়োগকারীরা কাক্সিক্ষত সফলতা না পাওয়ায় মাত্র এক বছরের মাথায় তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগে।
বিজিএমইএ সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে ছোট-বড় পোশাক কারখানা আছে ৬৭৬টি। বর্তমানে চালু আছে ৩৯১টি। তারমধ্যে সরাসরি আমদানি-রপ্তানি করছে ২৫০টি। বাকি ১৪১টি কারখানা দ্বিতীয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। অর্থাৎ তারা বড় কারখানাগুলো থেকে ফরমায়েস নিয়ে পোশাক তৈরি করে, সরাসরি রপ্তানিতে যুক্ত নয়। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্তপূরণ করতে না পারা ও রপ্তানি আদেশ সংকটে পাঁচ বছরে বন্ধ হয়েছে প্রায় ২৮৫টি কারখানা। তারমধ্যে ২০১৬ সালেই বন্ধ হয় একশটির বেশি।
চট্টগ্রাম গার্মেন্টসশিল্প শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শফর আলী বলেন, পোশাকশিল্প ধ্বংস করতে এখানকার কিছু ব্যবসায়ী ও সংগঠনের নেতাকর্মীরা বিদেশিদের কাছে এই শিল্প নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। অথচ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের সূচনা হয়েছিল চট্টগ্রামেই। সেই চট্টগ্রামেই এখন পোশাকশিল্পে কেউ বিনিয়োগ করতে আগ্রহী নন। বিনিয়োগ তো হচ্ছেই না, বরং যেসব প্রতিষ্ঠান কোনো মতে টিকে আছে সেগুলোও বন্ধ হচ্ছে, যা খুবই দুঃখজনক।
সূত্রমতে, গত ২০১৪ সালে দেশের মোট রপ্তানির ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ রপ্তানি হয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। ২০১৫ সালে সেটি দাঁড়ায় ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে রপ্তানি হয়েছে ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত তিন বছরে চট্টগ্রামের পোশাকশিল্প থেকে রপ্তানি হয় ১ দশমিক ৪৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক।
২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে পোশাক রপ্তানি খাতে উৎসে কর কর্তনের হার ১ শতাংশ করায় পোশাকশিল্পের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বেড়েছে প্রায় ৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। বর্তমানে ডলার কিনতে হচ্ছে ৮০ টাকারও নিচে। গত ৫ বছর আগে ৮৫ টাকায় ক্রয় হতো। এরই মধ্যে ন্যূনতম মজুরি ও বেতন খাতে ব্যয় বেড়েছে ২২৩ শতাংশ। এ ছাড়া গত ১ মার্চ থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭ দশমিক ২৪ টাকা বেড়েছে। এর আগে বিদ্যুতের ইউনিট মূল্যও গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ বেড়েছে। ফলে অনেক মালিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো. আবদুল হাই খান আমাদের সময়কে বলেন, চট্টগ্রামে মাঝারি আর ছোট গামের্ন্টস বন্ধ হচ্ছে বেশি; যারা অধিকাংশ সময় দ্বিতীয় মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
চট্টগ্রামে বিনিয়োগ কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, গার্মেন্টস কারখানাগুলো সার্বক্ষণিক চালু রাখার জন্য দরকার গ্যাস ও বিদ্যুৎ। চট্টগ্রামে গ্যাসের ন্যূনতম চাহিদা ধরা হয় ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট; কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ মিলছে মাত্র ২২০ থেকে ২৮০ মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে দিন দিন গ্যাসসংকট তীব্র হচ্ছে। বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এই ব্যবসায় প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আগে ছোট পরিসরে গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও এখন বৃহৎ পুঁজি ছাড়া নতুন কোনো কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হবে না। কারণ অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের শর্ত পূরণ করতে হলে হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হবে। ফলে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তরা এই ব্যবসা থেকে সরে আসছেন। তবে এই শিল্প ঘুরে দাঁড়াবে, যখন অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো চালু হয়ে যাবে; তখন বিনিয়োগ বাড়বে।