ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের জন্য গত জানুয়ারিতে ১০ পিস জিপার ও সমসংখ্যক বাটনের একটি নমুনা পার্সেল জার্মানিতে পাঠায় পোশাক খাতের বড় প্রতিষ্ঠান ক্লাসিক গ্রুপ। ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি এই জিপার ও বাটন পছন্দ করেনি। ভিন্ন মানের নতুন জিপার ও বাটনের নমুনা পাঠায় তারা। ই-মেইল বার্তায় তারা জানায়, তাদের পাঠানো জিপার ও বাটন ব্যবহার করে প্যান্ট তৈরি করে চার সপ্তাহের মধ্যে জার্মানিতে পৌঁছাতে হবে। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কাগজপত্র নিয়ে ক্রেতার পাঠানো নমুনা সেই জিপার ও বাটনের আর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। এক সপ্তাহ পর শুধু বাটন পাওয়া গেল, জিপার আর মিললই না। বাধ্য হয়ে ক্রেতার কাছে ক্ষমা চেয়ে রফতানি আদেশ আরও দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান গ্রুপের এমডি শহিদুল্লাহ আজিম। ক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পোশাকের ইউনিটপ্রতি আরও ৫ সেন্ট কম অফার করা হয় বলে সমকালকে জানান তিনি। জরুরি মুহূর্তে বিমানে নমুনা পণ্য আনা-নেওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রায়ই এ রকম চুরি, সময় ক্ষেপণের শিকার হতে হয় রফতানিকারকদের। এ ছাড়া বন্দরে শেড না থাকায় প্রচুর মালপত্র নষ্ট হয়। এভাবে বছরে এক বিলিয়ন ডলার বা ৮ হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়ছেন শুধু পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপ প্রতিবেদনে এ পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক্কায়ন ব্যবস্থাপনায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিস্থিতিও সংকটজনক। বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে বছরে ১০০ কোটি ডলার বা আট হাজার কোটি টাকার রফতানি আয় হারাচ্ছে তৈরি পোশাক খাত। এ বন্দরের পরিচালন কর্মঘণ্টাও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অনুকূল নয়। পরিচালনায় দক্ষতার ঘাটতিও প্রকট। এসব পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা জরুরি ভিত্তিতে উন্নয়নের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য সম্প্রসারণে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের শুল্ক্কায়ন সুবিধা সংক্রান্ত এ জরিপ গত জুন-জুলাই সময়ে পরিচালনা করা হয়। বন্দর ব্যবহারকারী ১১৫ ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এ জরিপ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের জন্য হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তৈরি পোশাকের স্যাম্পল বা নমুনা সময়মতো ক্রেতার কাছে পাঠানো ও ক্রেতার কাছ থেকে দেশে আনা এ খাতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রক্রিয়া। অথচ বন্দরের ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে এ কাজে অস্বাভাবিক সময় লেগে যায়। এতে রফতানি আদেশ হারানোর ঝুঁকিতে পড়েন উদ্যোক্তারা। কারণ, এ ধরনের প্রক্রিয়ায় ক্রেতাদের দেওয়া সময়ের মধ্যে দ্রুতই সাড়া দিতে পারেন প্রতিযোগী দেশগুলোর উদ্যোক্তারা। জরিপে বলা হয়, প্রতিদিন প্রায় ৩ হাজার টন পণ্য হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরে আটকা পড়ে। এতে পরদিন পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি পণ্যসহ কুরিয়ার শিপমেন্ট হয়ে থাকে। বেশ কিছু কার্গো বিমান এ বন্দর
ব্যবহার করে থাকে। অথচ বন্দরের সুযোগ-সুবিধা এখনও সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় নয়। পর্যাপ্ত শেড নেই, ওয়্যার হাউস নেই। ব্যবস্থাপনায় জড়িত মানবসম্পদও দক্ষ নয়। এসব কারণে পণ্য বন্দরে এলে ছাড় করাতে জট তৈরি হয়। জরিপে নিরাপত্তা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার সময় নির্ধারণ, প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, পণ্য ছাড়করণ দ্রুততার সঙ্গে সম্পম্ন করার সুপারিশ করা হয়েছে।
জরিপে নেতৃত্ব দেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান। জানতে চাইলে সমকালকে তিনি বলেন, যদিও সারা বছরই আমদানি-রফতানি চলে, তবে চট্টগ্রাম বন্দরে সমস্যা দেখা দিলেই জরুরি ভিত্তিতে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের ব্যবহার অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। কারণ পোশাক খাতের জন্য লিড টাইম (ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানোর সময়) খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জরুরি মুহূর্তে প্রয়োজনীয় সেই সেবাটি পান না রফতানিকারকরা। বিমানবন্দরে ২৪/৭ সেবার কথা বলা হয়। অথচ জরিপে তারা দেখেছেন, সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টার পর আর কোনো কাজ হয় না। তিনি বলেন, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য বিমানবন্দরটি মোটেই প্রস্তুত নয়। অথচ ২০২১ সালের মধ্যে ৬০ বিলিয়ন ডলার রফতানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। বাড়তি সেই সেবার চাপ কীভাবে সামাল দেওয়া সম্ভব হবে? বাণিজ্য বাড়াতে অবশ্যই এ বিষয়ে সরকারকে মনোযোগ দিতে হবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, পোশাক খাতের মূল কাঁচামাল জাহাজেই আসে। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে কিছু এক্সেসরিজ যেমন প্রাইস ট্যাগ, নিরাপত্তা ট্যাগ ইত্যাদি আসে বিমানযোগে। এ ছাড়া ক্রেতাদের পছন্দ অনুযায়ী বাটন, জিপারসহ কিছু এক্সেসরিজ নির্দিষ্ট দেশ থেকে আনতে হয়। প্রধানত এসব কাঁচামালই জরুরি ভিত্তিতে বিমানে আনতে হয়। এসব কাঁচামাল পরিমাণে বেশি না হলেও গোটা রফতানি প্রক্রিয়ার অপরিহার্য অংশ। যেমন রফতানির জন্য প্রায় প্রস্তুত পণ্য সাধারণ একটা প্রাইস ট্যাগের জন্য ক্রেতাকে সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। বিমানবন্দরে সময় নষ্ট হওয়ার কারণে সময়মতো রফতানি পণ্য ক্রেতাদের কাছে পৌঁছাতে চট্টগ্রাম বন্দরের পরিবর্তে আবার বিমানযোগে পরিবহন করতে হয়। এতে দুদিক থেকে আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন রফতানিকারকরা।