দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক শিল্পের রূপকল্প অনেকটাই রূপকথায় পরিণত হতে চলেছে। বিশ্ববাজার মন্দা, পোশাকের চাহিদা কমে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এমন সব নানা সমস্যার ফলে খাতটি বর্তমানে ক্রান্তিকাল পার করছে। তবু উদ্যোক্তাদের আশা সরকারের নীতি সহায়তা পেলে পোশাকশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারে।
তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ খাতটির নানা সমস্যা চিহ্নিত করে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক ৫০ বিলিয়ন বা ৫ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের রূপকল্প হাতে নেয়। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন এখন অনেকটা দুঃসাধ্য।
কারণ এ রূপকল্প যখন তৈরি করা হয় ওই সময় দেশের পোশাকশিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশের বেশি। কিন্তু গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) এ প্রবৃদ্ধি কমে এসেছে ০.২০ শতাংশে। এ সময় বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি কমলেও ভারতের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৮ শতাংশ এবং দাম কমেছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। অথচ গত দুই বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৮ শতাংশ।
মজুরি খরচ বেড়েছে ৩২.৩৫ শতাংশ। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশগুলোতে সরকারের নানা সহায়তার ফলে বাংলাদেশের পোশাক খাত ক্রমেই এর প্রতিযোগিতা সক্ষমতা হারাচ্ছে।
ভারত সরকারের প্রণোদনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশটি কারখানার প্রযুক্তি উন্নয়নে ভর্তুকি ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে করেছে ৩০ শতাংশ। ডিউটি ড্র ব্যাক রপ্তানির বিপরীতে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ হারে সুবিধা দেয়। শ্রমিক-কর্মচারীদের প্রভিডেন্ট ফান্ডে কারখানার মালিকরা ১২ শতাংশ হারে কন্ট্রিবিউশন করত। বর্তমানে ওই ১২ শতাংশ সরকারি তহবিল থেকে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ১ এপ্রিল থেকে ৫ বছরের জন্য রপ্তানিকারকদের ব্যাংকঋণের সুদের ওপর ৩ শতাংশ হারে ভর্তুকি দিচ্ছে। হরিয়ানা রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে কারখানাভেদে ২৫ থেকে ৫০ লাখ রুপি পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। ঝাড়খণ্ড রাজ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে ৫ বছরের জন্য প্রতি মাসে মহিলাদের ৬ হাজার এবং পুরুষদের ৫ হাজার রুপি ভর্তুকি দেওয়া হয়। মূলধনী যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে বিনিয়োগের ওপর কারখানাপ্রতি ২০ শতাংশ বা ভর্তুকি বাবদ সর্বোচ্চ ৫০ কোটি রুপি পর্যন্ত দেওয়া হয়। এ ছাড়া নতুন কারখানা স্থাপনে ব্যাংকঋণের সুদের ৭ শতাংশ বা সমুদয় সুদের ৫০ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয়।
বাংলাদেশের পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধি কমে আসার কারণ উল্লেখ করে ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বিগত চার বছরে ডলারের বিপরীতে প্রতিযোগী দেশগুলোর মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশি টাকা শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশি টাকার দাম বেড়েছে ৭.৬৬ শতাংশ। অন্যদিকে কমেছে পাকিস্তানি রুপির ১৫.৩৯ শতাংশ, ভারতীয় রুপি ৪০.০১ শতাংশ, তুরুস্কের লিরা ১০২ শতাংশ, ভিয়েতনামিজ ডং ৪.৪১ শতাংশ, চায়নিজ ইয়ান ৪.৯৫ শতাংশ ও শ্লীলঙ্কার রুপি ২৩.৫৪ শতাংশ।
পোশাকের দরপতনের চিত্রে দেখা যায়, ২০১৬ সালের শেষ ৩ মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাকের দর কমেছে ৪.৭১ শতাংশ। একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ৩.৩০ শতাংশ। চলতি বছরও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। গত জানুয়ারিতে ইইউতে দর কমেছে ৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ৪.৩৩ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসেও দর কমেছে একই হারে। উৎপদান খরচ বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে বলা হয়, গত ২ বছরে অ্যাক্সেসরিজ, প্যাকেজিং ও ওয়াশিং খরচ বেড়েছে প্রায় ৪.৮৮ শতাংশ, বিদ্যুৎ খরচ ১৫ শতাংশ, গ্যাস খরচ ৭.১৪ শতাংশ এবং পরিবহন খরচ বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
ঢাকা বিমানবন্দর ও চট্টগ্রাম বন্দরের স্থবিরতার কথা উল্লেখ করে বলা হয়, চার মাস ধরে জাহাজ ও কনটেইনার জটের কারণে নজিরবিহীন স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। শুল্ক স্টেশনগুলো ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার পরও বহির্নোঙরের জাহাজগুলো গড়ে ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। এ ছাড়া কনটেইনার ওঠা-নামার জন্য ২৯৯টি যন্ত্রপাতি দরকার হলেও আছে মাত্র ৮৭টি। আর কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের জন্য ৮৯৫টির জায়গায় রয়েছে মাত্র ২৮৫টি। এ ছাড়া ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে ইইউ, যুক্তরাজ্য, জার্মানি বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে নিরাপত্তার কারণে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এর ফলে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের মালিকরা আর্থিকভাবে দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
পোশাক খাতের সংস্কারের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাত সংস্কারে চাপ আসে ক্রেতাদের কাছ থেকে। এ সময় বাংলাদেশের পোশাক কারখানার সংস্কারে কাজ করে ইউরোপীয় ক্রেতাদের সংগঠন অ্যাকর্ড এবং উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট সংগঠন অ্যালায়েন্স। তাদের চাপে পড়ে কারখানা সংস্কার করতে গিয়ে ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলোকে খরচ করতে হয়েছে ৫ থেকে ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত। এসব খরচ হয় কাঠামোগত সংস্কার ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, অগ্নি নিরাপত্তা ও প্রতিরোধ কার্যক্রমে ফায়ার ডোর ১০ লাখ টাকা, ফায়ার হাইড্রেন্ট সিস্টেম স্থাপন ১ কোটি টাকা, অটোমেটিক ফায়ার অ্যালার্ম বা ডিটেনশন সিস্টেম ৩০ লাখ টাকা, ফায়ার স্প্রিংকলার সিস্টেম স্থাপন ৫০ লাখ টাকা, বাসবার ট্রানকিং সিস্টেমে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়।
সস্তা শ্রমের কারণে চীনের কম দামের পোশাক পণ্যের বাজার বাংলাদেশে আসার একটা বড় প্রত্যাশা তৈরি হলেও সেই জায়গায় আবার হতাশা তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কম্পানির এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, পোশাক উৎপাদনে নতুন করে মনোযোগী চীন। শ্রম মজুরি বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে পোশাক উৎপাদন কমিয়ে আনে দেশটি। এতে চীনা প্লাস নীতির সুবাদে বাংলাদেশের প্রতি ক্রেতাদের বাড়তি আগ্রহ দেখা গেছে। তবে নতুন করে চীন আবার পোশাকে মনোযোগী হয়েছে। একজন শ্রমিক একসঙ্গে একাধিক মেশিন চালিয়ে নিতে পারে এ রকম প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে চীনারা। ফলে চীন এখনো ক্রেতাদের কাছে অপরিহার্য নাম।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিজিএমইএ সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির কালের কণ্ঠকে বলেন, এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে তৈরি পোশাক খাতের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান বৃদ্ধি ঠেকাতে আমদানি এবং রপ্তানির জন্য দ্বৈত মুদ্রানীতি করা যেতে পারে। এ ছাড়া টাকার দর বাড়ায় রপ্তানিকারকদের যে ভর্তুকি দিতে হয় ওই টাকা নগদ সহায়তা হিসেবে দেওয়া যেতে পারে।