একই জায়গায় পাশাপাশি চারটি গার্মেন্টের মালিক একজন। শিল্পনগরী নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত এসব গার্মেন্টের ভবন নির্মাণে নকশা করেছেন দেশের শীর্ষ এক প্রকৌশলী। টেকসই ভবন নির্মাণে যেসব মানদণ্ড অনুসরণের দরকার সবই করা হয়েছে নির্মাণ প্রক্রিয়ায়। ভবনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ৯৯ বছর। ভূমিকম্পের সহনশীলতা ধরা হয় রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার। অর্থাৎ কমপ্লায়েন্ট গার্মেন্ট বলতে যা বোঝায় সব থাকার পরও তাতে তথাকথিত সংস্কারের অযৌক্তিক চাপ দেয় ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড। ওই গার্মেন্ট মালিককে বলা হয়, ভবনগুলোর স্ট্যাকচারাল রেট্রোফিটিং বা অবকাঠামোগত নিরাপত্তা ত্রুটি দূর করতে হবে। এর জন্য মাটির নিচে ভবনের ফাউন্ডেশনের গ্রেটভিম এবং ভিম থেকে ওপরে উঠে আসা সব পিলারের চারপাশে পুনরায় রড, ইট, বালি ও সিমেন্ট দিয়ে এর পরিধি বাড়াতে হবে, যা অনেকটা মোটাতাজাকরণ পদ্ধতি ছাড়া আর কিছু নয়।
এ রকম সংস্কারের কোনো দরকার না পড়লেও ব্যবসার স্বার্থের কথা বিবেচনায় নিয়ে এ প্রস্তাবে কোনো আপত্তি দেননি ওই গার্মেন্ট মালিক। সহজে এ বিষয়টি মেনে নেয়ার পর এখানেই ঘটে যত বিপত্তি। এবার চাপ আসে তদারকির জন্য অ্যাকর্ড নিয়োজিত প্রকৌশলীকে মাসিক নির্ধারিত বেতনে নিয়োগ দিতে হবে। সংস্কার সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত এ নিয়োগ বহাল রাখতে হবে। এতেও আপত্তি ছিল না তার। তবে অ্যাকর্ডের অযৌক্তিক আবদারের এখানেই শেষ হয়নি। এবার বলা হয়, চারটি ভবন সংস্কারে অ্যাকর্ডের চার প্রকৌশলীকে আলাদাভাবে নিয়োগ এবং প্রত্যেককে সমান হারে মাসিক বেতন ও বেতনের ওপর আরোপিত ট্যাক্স-ভ্যাট বহন করতে হবে। উদ্যোক্তা হিসাব করে দেখলেন, প্রত্যেক প্রকৌশলীর পেছনে তার প্রতি মাসে ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা করে প্রায় ৭ লাখ টাকা শুধু এ খাতেই খরচ যাবে। যে কারণে তিনি এটা মানতে নারাজ। যুক্তি দেখালেন, মালিক একজন। ভবনগুলোও একই কম্পাউন্ডে। সংস্কারের ধরন অভিন্ন। একজন প্রকৌশলীই এ কাজে যথেষ্ট। চারজন কেন? বাদানুবাদের একপর্যায়ে অ্যাকর্ড কিছুটা পিছু হটে দুই প্রকৌশলী নিয়োগের শর্ত দেয়।
অহেতুক ঝামেলার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে গত বুধবার ভুক্তভোগী এ উদ্যোক্তা যুগান্তরের কাছে ক্রেতা জোট অ্যাকর্ডের স্বেচ্ছাচারিতার নানাদিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘অ্যাকর্ড যদি নীতিবিবর্জিত না হতো তাহলে একজনের জায়গায় চার প্রকৌশলী নিয়োগের আবদার করত না। আবদার সঠিক হলে চার থেকে কিছুতেই দুয়ে নেমে আসত না। আবার এটাও ঠিক- সংস্কার শর্ত না মানলে অ্যাকর্ড আমার বায়ার প্রতিষ্ঠানকে নানাভাবে ভুল বার্তা দিয়ে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করত।’
সংশ্লিষ্টদের দাবি, অ্যাকর্ডের এই অযাচিত হস্তক্ষেপ ওই চার কারখানায়ই থেমে নেই। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, টঙ্গী, আশুলিয়া, গাজীপুর এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত অ্যাকর্ডভুক্ত সব গার্মেন্টের উদ্যোক্তাদেরই কমবেশি স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়েছেন। এখনও হচ্ছেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থা আধুনিকায়নের নামে ফায়ার ডোর, ফায়ার হাইড্রেন্ট, অটোমেটিক ফায়ার অ্যালার্ম বা ডিটেকশন সিস্টেম, ফায়ার স্প্রিংকলার সিস্টেম, বৈদ্যুতিক সংস্কারসহ বিভিন্ন সামগ্রী স্থাপনেও দারুণভাবে ভুগতে হচ্ছে উদ্যোক্তাকে। শুধু তাই নয়, তাদের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট দেশ ও নির্দিষ্ট কোম্পানি থেকে নির্ধারিত দামেই এসব যন্ত্রপাতি কিনতে হচ্ছে। এতেও অতিরিক্ত খরচের মুখোমুখি হতে হচ্ছে উদ্যোক্তাকে।
ভুক্তভোগী উদ্যোক্তারা বলছেন, অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের উদ্দেশ্য এ দেশের পোশাক খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়। ওরা চাইছে তৃতীয় কোনো গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে। যারা বাংলাদেশের পোশাক খাত দাবিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্র করছে, ওরা তাদেরই সহযোগী। এ কারণেই সংস্কারের নামে দুই ক্রেতা জোটই যেনতেন প্রেসক্রিপশন দিচ্ছে। পাশাপাশি ক্রেতা হারানোর জুজুর ভয় দেখিয়ে তা মানতেও বাধ্য করা হচ্ছে। আসলে ওরা চায় এ দেশের উদ্যোক্তাদের কারখানা চালানোর আর্থিক সক্ষমতা কেড়ে নিতে। সচল গার্মেন্টগুলো একের পর এক বন্ধ করে দিতে। যাতে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ে। ওদের থাবায় হচ্ছেও তাই। অপরদিকে বেকার ও বিক্ষুব্ধ শ্রমিক দিয়ে মালিকদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামিয়ে একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা সব সময় আছে। যার সুযোগ নিচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলো। এ কারণে অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্স এ দেশের পোশাক খাত নিয়ে বিদেশি ব্র্যান্ড বায়ারদের কাছে মিথ্যাচার করছে। সংস্কার এগোচ্ছে না বলে অতিরিক্ত মেয়াদে থাকার নাটক করছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারে তারা বাংলাদেশের পোশাক নিয়ে নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে। ফলে বায়াররা পোশাকের ন্যায্যমূল্য দিচ্ছে না। ক্রেতারা ভিন্ন দেশে চলে যাচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বুধবার বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সংস্কার তদারকির নামে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্সের অযৌক্তিক কিছু মেনে নেয়া হবে না। টার্মস অব রেফারেন্সের (টিওআর) বাইরে ওদের কিছু করতে দেয়া হচ্ছে না। বিজিএমইএ এ বিষয়ে গভীর পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি আরও বলেন, ৫০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের দিন থেকেই দেশের পোশাক খাত দাবিয়ে রাখতে নানামুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এ ষড়যন্ত্র রুখতে তিনি উদ্যোক্তাদের আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন। এক প্রশ্নের জবাবে তোফায়েল আহমেদ বলেন, ২০১৮ সালের ৩০ মের পর কোনোভাবেই অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সকে দেশে আর কার্যক্রম চালাতে দেয়া হবে না। তার প্রয়োজনও হবে না।
জানতে চাইলে বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্স প্রশ্নে যুগান্তরকে বলেন, ‘সবারই ব্যথা আছে। কারও কম, কারও বেশি। একটা সময় ছিল কিছু বলার ছিল না। এখন সেই সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কারও কাছে মাথানত করে ব্যবসার দিন ফুরিয়ে গেছে। আমরা জানিয়ে দিয়েছি অতিরিক্ত মেয়াদে বাংলাদেশে তাদের প্রয়োজন নেই।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুই ক্রেতা জোটের প্রেসক্রিপশন না মানলে সংশ্লিষ্ট কারখানা কালোতালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। এই কালোতালিকার অর্থ হচ্ছে জোটভুক্ত ব্র্যান্ড বায়ারদের সঙ্গে এসব কারখানার ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করা। এর ফলে কোনো উদ্যোক্তা তাদের শর্ত মেনে কাজ না করলে চুক্তিবদ্ধ দুই জোটের ২১৮টি ব্র্যান্ড বায়ারের সঙ্গে কেউ ব্যবসা করতে পারছে না। ইতিমধ্যে ক্রেতা জোটের রোষানলে পড়ে বিদেশি ক্রেতা হারিয়েছে দেশের ২৪৩ উৎপাদনমুখী কারখানা। এর মধ্যে ১৫৯টি কারখানার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অ্যালায়েন্স। অ্যাকর্ডের প্ররোচনায় ব্যবসা হারিয়েছে ৮৪ কারখানা। ক্রেতা না থাকায় এসব গার্মেন্টের উৎপাদন এখন বন্ধ। এমনকি তারা দেশের অন্য রফতানিকারকের হয়ে সাব কন্টাক্টিংয়েও পোশাক তৈরির সুযোগ পাচ্ছে না। সেখানেও এ দুই ক্রেতা জোট সতর্ক নজরের কারণে অর্ডার বাতিলের আশঙ্কায় এসব উদ্যোক্তার কেউ কাজ দিতেও সাহস পাচ্ছে না। এর বাইরে পরিদর্শনে নানাবিধ ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে অ্যাকর্ডের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে কারখানা বন্ধ হয়েছে ২০৭টি। যার মধ্যে ১০৪টিই স্থানান্তরের অজুহাতে বন্ধ করা হয়। এছাড়া অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের সব শর্ত ও সংস্কারের চাপ সামলে ব্যবসায় টিকে থাকা এসব কারখানার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। এছাড়া সারা বিশ্বে নতুন নতুন প্রতিযোগীর আবির্ভাব, বিশ্ববাজারে দরপতন, রফতানি আদেশ কমে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রম অসন্তোষের মতো ঘটনায় আর্থিক সংকটে পড়েও অনেক গার্মেন্ট উদ্যোক্তাকে ব্যবসা গোটাতে হয়েছে। বন্ধ কারখানার মধ্যে বিজিএমইএর সদস্য কারখানার সংখ্যা ১,২৩১ ও বিকেএমইএর সদস্যভুক্ত ২৬৯ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৫৬৯টি গার্মেন্ট অন্যত্র স্থানান্তর বা একীভূত করা সম্ভব হলেও বাকি ৯৩১ গার্মেন্ট পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে প্রায় আড়াই লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছে।
বিজিএমইএর তথ্যানুসারে সংগঠনটির নিবন্ধিত তৈরি পোশাক কারখানার সংখ্যা ৬,১৯৬টি। এর মধ্যে নানা কারণে ১,৭৬৫টি কারখানা বন্ধ করা হয়েছে সংগঠনটির নিজস্ব উদ্যোগে। এসব কারখানা বাদ দিলে নিবন্ধিত কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪,৪৩১টি। সর্বশেষ চলতি মাসে বিজিএমইএর মেম্বারশিপ শাখার হালনাগাদ তথ্য মতে, এদের মধ্যে সক্রিয় কারখানার সংখ্যা ৩,২০০টি। অর্থাৎ রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর গত সাড়ে চার বছরে রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও আশপাশের এলাকায় ১২৩১ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যার বেশির ভাগই ছোট ও মাঝারি পর্যায়ের এবং শেয়ার্ড বিল্ডিং কারখানা (একই ভবনে একাধিক গার্মেন্ট)।
চট্টগ্রামের অ্যারিয়ন ড্রেসেস লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মদ আতিক যুগান্তরকে বলেন, শর্ত না মানায় ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে অ্যাকর্ড। তিনি বলেন, তেমন ত্রুটি না থাকলেও সংস্কারের বিশাল তালিকা ধরিয়ে দেয় তারা। অ্যাকর্ডভুক্ত নেদারল্যান্ডসের বায়ার আমাকে খরচ জোগানোর আশ্বাস দেয়। আমিও সংস্কারে সায় দিই। এরপরই শুরু হয় অ্যাকর্ডের এটা-ওটা উপর্যুপরি চাপিয়ে দেয়া অযৌক্তিক সব ফরমায়েশ। ততদিনে আমার ৫০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। বায়ার আশ্বাস দিয়েও টাকা দেয় না। অথচ অ্যাকর্ড ও বায়ার শর্ত দেয় কারখানার বাইরে পণ্যের সেল সেন্টারে ‘স্মোক ডিটেক্টর’ বসানোর। কিন্তু ওই সেল সেন্টারের সঙ্গে কারখানার নিরাপত্তার কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় আমি মানতে রাজি হইনি। এতেই সম্পর্কের অবনতি। শেষ পর্যন্ত আমাকে অ্যাকর্ড ও তার বায়ার দুটোই ছাড়তে হয়।
আবার শর্ত মেনে অ্যাকর্ডের ছাড়পত্র নিয়েছে জে কে ফেব্রিক্স। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম খানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ওদের কথামতোই বিল্ডিংয়ের রেট্রোফিটিং কাজ করতে হয়েছে। কারণ এটা না করলে ওরা ছাড়পত্র দিত না। এটা ছাড়া বায়ারদের সঙ্গে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও যেত না।
লিবাটি ফ্যাশনের চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক এ প্রসঙ্গে বলেন, অ্যাকর্ড আমার ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে। চারটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ছিল আমার। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যবসায় প্রতিদিন এক কোটি টাকা ক্যাশ পেতাম। কিন্তু অ্যাকর্ডের রোষানলে পড়ে একে একে সব ক্রেতা হারিয়ে এখন কারখানা বন্ধ। এখন এক টাকাও কামাই নেই। ওদের রুখতে না পারলে এ দেশের পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
পোশাক খাতে নিট পণ্যের উৎপাদকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি একেএম সেলিম ওসমান যুগান্তরকে বলেন, সংস্কারের ধুয়ো তুলে ওরা অনেক কারখানা মালিককে অযাচিত ও অতিরিক্ত ব্যয়ের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি এই অযাচিত ব্যয়ের শিকার। একই সংগঠনের সাবেক ঊর্ধ্বতন সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে বলেন, ওদের স্বেচ্ছাচারিতা ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। আবার মানতে গিয়েও আর্থিক সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না।