Home Bangla Recent তৈরি পোশাক শিল্পে অশনি সঙ্কেত

তৈরি পোশাক শিল্পে অশনি সঙ্কেত

স্বাধীনতার সূচনালগ্নে বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর। শিল্পায়নে ছিল অনগ্রসর। স্বাধীনতার মাত্র ১২ বছর পরই এ রূপরেখা বদলে যায়। রফতানি বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং জিডিপি যেকোন দৃষ্টিকোন থেকেই দেখা হোক না কেন বর্তমানে পোশাক শিল্পের অবদান অপরিসীম। ১৯৮৪ সালে দেশের মোট রফতানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ। ছয় বছরের ব্যবধানে ১৯৯০ সালে রফতানি আয়ে এ খাতের অবদান বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এরপর ২০ বছরের ব্যবধানে রফতানি আয়ে পোশাক খাতের অবদান ২০১০ সালে ৭৫ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৮২ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশে শ্রমবাজার এবং দক্ষ মানবসম্পদের ঘাটতি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, নব্বইয়ের দশকের প্রথম পাঁচ বছরে পোশাক খাতের কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধিটা ভাল হলেও এর পরের ১০ বছরে গতিটা নিম্নমুখী হয়। তবে ২০০৫-১০ সময়ে এ গতি আগের ১০ বছরের তুলনায় শুধু উর্ধ্বমুখীই হয়নি, প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে যায়। গতিটা একটা জায়গায় এসে আটকে যায় ২০১০ সালের পরে এবং সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দাঁড়ায় ২০১৩-১৫ সময়ে।

প্রতিবেদনে ২০০৫-১০ সময়ের প্রবৃদ্ধিকে ‘উল্লেখযোগ্য’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ, এই সময়টা হচ্ছে ২০০৫ সালে মাল্টি ফাইবার এ্যারেঞ্জমেন্টের (এমএফএ) আওতায় কোটাপ্রথা বাতিল হওয়ার পরের সময়। অনেকের আশঙ্কা কাটিয়ে এই সময়ে পোশাক খাত নিজের অবস্থান বরং আরও পোক্ত করেছিল।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধস ও তাজরীন গার্মেন্টস-এ অগ্নিকান্ড ট্র্যাজেডির পর থেকে তৈরি পোশাক শিল্পের নিম্নমুখী গ্রাফ ও হলি আটির্জানের দানবীয় আস্ফালন বিদেশী বায়ারদের বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দেয়। যার প্রভাব আমরা অনুভব করছি। আইএমএফের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে চলতি বছরে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ৭ দশমিক ১ শতাংশ হবে। আইএমএফ আরও বলেছে, আগামী দুই বছর অর্থাৎ ২০১৮ ও ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৭ শতাংশ করে প্রবৃদ্ধি হবে। আশার কথা হলেও দেশের রফতানি আয়ের মূল খাত তৈরি পোশাক শিল্পের ডেভেলপমেন্ট গ্রাফ দিন দিন হতাশ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গত বছর আমদানি হওয়া তৈরি পোশাকের ৬ দশমিক ৫৭ শতাংশ যোগান দিয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে সেটি কমে ৬ দশমিক ৪১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। তবে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও ভারতের বাজার ঠিকই বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ৩০৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছর একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৩২৩ কোটি ডলারের পোশাক। সেই হিসাবে এবার রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ।

প্রচলিত বা বড় বাজারের মতো নতুন বাজারেও ধাক্কা খেয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। গেল অর্থবছর শীর্ষ ১১ নতুন বাজারের মধ্যে ৮টিতে পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে বিদায়ী ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২ হাজার ৮১৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। এর মধ্যে প্রচলিত তিন বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রফতানি হয়েছে ২ হাজার ৩৯০ কোটি ডলার বা ৮৪ দশমিক ৯১ শতাংশ। নতুন বাজারে রফতানি হয় ৪২৪ কোটি ৮৯ লাখ ডলারের পোশাক। এটি এর আগের অর্থবছর থেকে দেড় শতাংশ কম। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪৩১ কোটি ৭৪ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল। তখন প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১০ দশমিক ৪৮ শতাংশ। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ। আগের অর্থবছর ছিল ২২ দশমিক ৩১ শতাংশ। বিজিএমইএর সহ-সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, ‘সামগ্রিকভাবেই পোশাক রফতানি কমে গেছে। সেই প্রভাব নতুন বাজারেও পড়েছে। তবে নতুন বাজারে পোশাক রফতানি কমে যাওয়াটা আমাদের জন্য বিপদ সঙ্কেত। কারণ প্রচলিত বাজারে রফতানি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় আমরা নতুন বাজারকে টার্গেট করে এগোচ্ছিলাম। ভবিষ্যতে তৈরি পোশাকের বড় বাজার ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি বাড়ানো কঠিন হবে। কারণ এসব দেশে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। সে জন্য ব্যবসা বাড়াতে নতুন বাজারই ভরসা। কয়েক বছর ধরেই পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তারা এমন যুক্তিতে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে শুল্কমুক্ত পণ্য রফতানি-সুবিধা চুক্তি, অন্যান্য অশুল্ক বাধা দূর, মেলা আয়োজনের মতো নানা উদ্যোগ নেয়ার দাবি করছেন।

বিভিন্ন দেশ থেকে রাশিয়া গত বছর ৫০০ কোটি ডলারের পোশাক আমদানি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ দেশটিতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পোশাক রফতানিকারক। তবে রাশিয়ায় পোশাক রফতানিতে ২০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। তুরস্কে ১৭ শতাংশের সঙ্গে বাড়তি সুরক্ষা শুল্ক আরোপ করা আছে। এ ছাড়া মেক্সিকোতে ২০-২৫, ব্রাজিলে ৪০ শতাংশ এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪৫ শতাংশ শুল্ক ও ১৪ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। সরকারী পর্যায়ে এসব দেশের সঙ্গে আলোচনা করে শুল্কমুক্ত সুবিধা আদায় কিংবা শুল্ক হ্রাস করা গেলে রফতানি বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, নতুন বাজারের মধ্যে জাপানে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছর সবচেয়ে বেশি ৭৪ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ায় রফতানি হয়েছে ৫৮ কোটি ডলারের পোশাক। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের চেয়ে গত অর্থবছর জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার রফতানি কমেছে যথাক্রমে ৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ ও সাড়ে ৮ শতাংশ। চীনে রফতানি হয়েছে ৩৯ কোটি ডলারের পোশাক। এ ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তুরস্কে গত অর্থবছর ৩৮ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়। এই বাজারে রফতানি কমেছে ১৭ শতাংশ।

কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের অবদান নিয়ে ১৯৯০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ২৫ বছরের একটি চিত্র তুলে ধরা হয়েছে বিআইডিএস প্রকাশিত প্রতিবেদনে। বলা হয়, ২৫ বছর আগে ১৯৯০ সালে পোশাক খাতে কর্মসংস্থান হয় ৫ লাখের মতো লোকের। আর ২০১৫ সালে কর্মসংস্থান হয় ৪০ লাখ লোকের, যার বড় অংশই নারী। তবে এই সময়ে একই গতিতে কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি হয়নি। বলা হয়েছে, ১৯৯০-৯৫ সময়ে কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ছিল ২৯ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। কিন্তু পরের পাঁচ বছরে অর্থাৎ ১৯৯৫-২০০০ সময়ে প্রবৃদ্ধি নেমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৯২ শতাংশে। ২০০০-০৫ সময়ে আরও কমে হয় ৪ দশমিক ৫৬ শতাংশ। তবে ২০০৫-১০ সময়ে এ প্রবৃদ্ধি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। এই পাঁচ বছরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ২০১০ সালের পর থেকে কর্মসংস্থান তৈরিতে পোশাক খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য হারে কমে নেমে আসে ১ দশমিক শূন্য ২ শতাংশে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান গ্যাস-বিদ্যুতের সঙ্কটে নতুন কারখানা গড়ে না ওঠাকে পোশাক খাতে কর্মসংস্থান তৈরির প্রবৃদ্ধি কমার অন্যতম কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন।

সিদ্দিকুর রহমান আরও বলেছেন, একদিকে পোশাকের বিশ্ব চাহিদা কমে গেছে, অন্যদিকে কমে গেছে দাম। নতুন কারও পক্ষে কারখানা করে এখন মুনাফা অর্জন সত্যিই কঠিন। ফলে খুবই স্বাভাবিক যে কর্মসংস্থান তৈরিতে এ খাতের অবদান কমবে এবং আরও কমার শঙ্কা রয়েছে।’

মূলত সস্তা শ্রমের সুযোগে দেশের পোশাক খাত যত দূর সম্ভব প্রতিযোগিতা সক্ষম হয় বলে বিআইডিএসের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ভবিষ্যতে সস্তা শ্রমের ওপর নির্ভর করে আর এগোনো সম্ভব হবে না। সরকারঘোষিত ৫০ বিলিয়ন ডলারের (পাঁচ হাজার কোটি ডলার বা চার লাখ কোটি টাকা) রফতানি লক্ষ্য পূরণ করতে গেলে তা আরও অসম্ভব হয়ে উঠবে। এ জন্য যে দক্ষ শ্রমশক্তির দরকার পড়বে, তা পাওয়াও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

বৈশ্বিক অস্থিরতা, আভ্যন্তরীণ নির্লিফততা এই খাতকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। তা সত্ত্বেও আবার ঘুরে দাঁড়াবার দৃঢ় প্রত্যয় দেশপ্রেমিক মেধাবী তরুণ উদ্যোক্তাদের চোখেমুখে। দরকার শুধু নীতি নির্ধারক পর্যায়ের মানসিকতার পরিবর্তন। তাহলে সাময়িক সমস্যা মোকাবেলা করে দেশ তার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাবে এ কথা বলা যেতেই পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here