দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে শিল্প সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে; সেটি তৈরি পোশাক খাত। মাত্র ১২ হাজার ডলার রপ্তানি দিয়ে যাত্রা শুরু করা এ শিল্পে এখন বছরে রপ্তানি হয় ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশেরও বেশি।
সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির।
তিনি বলেন, দেশের কর্মসংস্থানে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে এ খাত। বিশেষ করে গ্রামবাংলার অদক্ষ ও কম শিক্ষিত নারীদের জায়গা হচ্ছে এ খাতে। এ খাতে কর্মসংস্থান প্রায় অর্ধকোটি যার ৮০ শতাংশ নারী। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের ফলে চাঙ্গা হয়েছে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিও। একই সঙ্গে পোশাক খাতের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে বিশাল সংযোগ শিল্প। তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখলেও পোশাক খাতের অগ্রযাত্রায় নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে আমাদের। এসব প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে দেশ-বিদেশের একটি সংগবদ্ধ গোষ্ঠী জড়িত। যারা আমাদের অবদানের কথা ম্লান করে দিচ্ছে।
বর্তমানে পোশাক খাতের বড় সমস্যা কী এ বিষয়ে বিজিএমইএ সহসভাপতি বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিকভাবে নেতিবাচক প্রচারণা। তবে আশার কথা গত ৪ বছরে আমাদের পোশাকশিল্পে কর্মপরিবেশ নিরাপত্তায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বিগত দিনে এমনভাবে প্রচারণা হয়েছে যে আমাদের অধিকাংশ পোশাক কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ। অথচ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গ্রিন বা পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানা আমাদের বাংলাদেশে অবস্থিত। আমাদের এ শিল্পে এক নীরব সবুজ বিল্পব ঘটেছে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব খুব একটা ব্র্যান্ডিং হয়নি।
তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশ এখন পরিবেশবান্ধব গ্রিন তৈরি পোশাক কারখানা স্থাপনে নেতৃস্থানীয় অবস্থানে রয়েছে। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) সনদপ্রাপ্ত ৬৭টি গ্রিন বা সবুজবান্ধব কারখানা আছে আমাদের। এর মধ্যে ৭টি বিশ্বের শীর্ষস্থানীয়। এ ছাড়া আরো প্রায় ২৮০টি কারখানা ইউএসজিবিসিতে নিবন্ধিত হয়েছে এবং আরো অনেক কারখানা পরিবেশবান্ধব হওয়ার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এসব কারখানায় জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে তা খরচ বাঁচাচ্ছে, একই সঙ্গে পরিবেশের ক্ষতির পরিমাণও কমাচ্ছে।
পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার প্রসার টেকসই উন্নয়নের পথে এ শিল্পের অগ্রযাত্রার একটি অন্যতম পদক্ষেপ উল্লেখ করে মোহাম্মদ নাছির বলেন, ‘আমাদের দেশে পোশাকশিল্পের সবুজ বিপ্লব থেকে স্পষ্ট হয় যে ইতিবাচক পরিবর্তনে আমাদের উদ্যোক্তারা অনেক বেশি খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা রাখে। এ ক্ষেত্রে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মমতাময় পরিচর্যার কারণে গ্রিন কারখানা স্থাপনে বড় দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে সারা বিশ্বে। তার সরকারকে ধন্যবাদ জানাই আমাদের গ্রিন কারখানার জন্য করপোরেট ট্যাক্স কমিয়ে ১০ শতাংশ করার জন্য। ’
তিনি বলেন, বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক পোশাকশিল্পে নিজেদের সক্ষমতা ধরে রাখতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। আমাদের পোশাকশিল্পে এ জন্য উচ্চ প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কারখানাগুলো সেমি-অটোমেটিক মেশিনের পরিবর্তে অটোমেটিক মেশিন ব্যবহার করেছে। শিল্পে লো লিকর ডায়িং মেশিন, ওজন ওয়াশিং, জাকার্ড, অটো ট্রিমিংয়ের মতো অত্যাধুনিক মেশিনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবেশী দেশের উদাহরণ টেনে মোহাম্মদ নাছির বলেন, ভারতে ‘টেকনোলজি আপগ্রেডেশন ফান্ড স্কিম’-এর আওতায় পোশাক খাতে ভর্তুকির পরিমাণ ১৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি করে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া মূলধনি যন্ত্র ও যন্ত্রাংশে বিনিয়োগের ওপর কারখানাপ্রতি ২০ শতাংশ ভর্তুকি বাবদ সর্বোচ্চ ৫০ কোটি রুপি দেওয়া হয়। অন্যদিকে চীন কারখানা অটোমেশনের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা সক্ষমতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। কাজেই আমাদেরও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে সরকারকে। শিল্প-কারখানার আধুনিকায়নে ও উচ্চ প্রযুক্তির মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রে স্বল্প সুদে ও সহজ শর্তে ডলার মুদ্রায়, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে টাকায়, ঋণ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের আওতায় বিশেষ রিফাইন্যান্সিং স্কিম গ্রহণ করার পরামর্শ দেন তিনি।
দেশের পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানান, ‘আমাদের পোশাকশিল্পে গর্ব করার মতো অনেক বিষয় আছে। বিশেষ করে গত ৪ বছরে আমাদের পোশাকশিল্পে কর্মপরিবেশ নিরাপত্তায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। অথচ বিগত দিনে এমনভাবে প্রচারণা হয়েছে যে আমাদের অধিকাংশ পোশাক কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা পরিদর্শনের পরে দেখা গেল প্রায় ৯৮ শতাংশ কারখানাই নিরাপদ, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিরাপত্তা সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও ন্যাপের আওতায় আমাদের উদ্যোক্তারা মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে কারখানার নিরাপত্তা সংস্কার সম্পন্ন করেছে। অ্যাকর্ডের আওতাধীন ৭৭ শতাংশ ও অ্যালায়েন্সের আওতায় থাকা ৭৯ শতাংশ কারখানার নিরাপত্তা ত্রুটি সংশোধন হয়েছে। উদ্যোক্তা ও শ্রমিক সবার মন-মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। পোশাক কারখানাগুলো শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। ’
তিনি বলেন, একটি রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য ভাবমূর্তি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার ব্যাপারে সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে একটি স্লোগান— ‘মেইড ইন বাংলাদেশ উইথ প্রাইড’ বা ‘বাংলাদেশের পোশাক গর্বের’।
পোশাকশিল্পের সামাজিক দায়বদ্ধতা নিয়ে মোহাম্মদ নাছির বলেন, বর্তমানে দেশের কারখানাগুলো সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে শ্রমিকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমুখী উদ্যোগ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে শ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ, নারী শ্রমিকদের জন্য বিনা মূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিতরণ, তাঁদের সন্তানদের জন্য ডে-কেয়ার এবং অবৈতনিক স্কুল পরিচালনা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া কারখানাগুলোতে খাবার ভাতাসহ কিছু কারখানা বিনা মূল্যে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে। অনেক কারখানা ব্যতিক্রমধর্মী শ্রমিক কল্যাণমুখী উদ্যোগ নিয়ে থাকে।