দেশের তৈরি পোশাক খাতে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছেই। এ খাতে সুতা ও কাপড় রং করা এবং ধোয়ার কাজে প্রতিবছর ১ হাজার ৫০০ বিলিয়ন বা ১ কোটি ৫০ লাখ লিটার পানি ব্যবহার হচ্ছে। এ পানি দিয়ে ৮ লাখ মানুষ পুরোবছরের চাহিদা মেটাতে পারে। যা দিয়ে ঢাকা শহরের দুই দিনের পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। অথবা এ পানির মাধ্যমে অলিম্পিক গেমসের ছয় লাখ সাঁতার পুল পূরণ করা যাবে। গার্মেন্ট শিল্পে ব্যবহৃত এ পানির বেশির ভাগই অপচয় হচ্ছে। বাজারে বিদ্যমান প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপচয় রোধ করা সম্ভব। পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের (ওয়াসা) প্রতি লিটার পানির বর্তমান মূল্য অনুসারে, যার বাজার দর ৬১১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮০ টাকা ধরে)।
বিশ্বব্যাংকের সদস্য সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশনের (আইএফসি) সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৭৮৯টি ডাইং এবং ফিনিশিং কারখানা ভূ-গর্ভের পানি ব্যবহার ও পরিবেশ দূষণে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ কারখানাগুলোর মাধ্যমে প্রায় চার হাজার গার্মেন্ট কারখানায় উৎপাদিত পোশাক রং করা ও ধোয়ার কাজ করা হয়। আইএফসি ২০০ কারখানার ওপর পর্যবেক্ষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রতিবেদন তৈরির জন্য আইএফসি ঘনিষ্ঠভাবে গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় ৩৩টি ডাইং এবং ফিনিশিং ইউনিট গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আমরা যে জিন্স পরিধান করি, গড়ে প্রতিটি রং করা ও ধোয়ার কাজে ২৫০ লিটার পানি ব্যবহৃত হয়। এ পানির সবটুকুই ‘মিঠাপানি’ হতে হয়, যা একটি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ, এটি ভূ-গর্ভ থেকে পাম্প দিয়ে তোলা হয়। বৈশ্বিক মান অনুযায়ী গড়ে প্রতিটি জিন্স রং করা ও ধোয়ার কাজে ৬০-৭০ লিটার পানি ব্যবহার করা হয়।
আইএফসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূ-গর্ভ থেকে এ বিপুল পরিমাণ পানি তোলার কারণে দুটি বিপর্যয় ঘটছে। প্রথমত, আমরা একটি ফাঁকা ভূ-গর্ভ তৈরি করছি। এভাবে পানি তোলা হলে চরম বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। দ্বিতীয়ত, ভূ-গর্ভ থেকে বেশি বেশি পানি তোলার ফলে ‘পানির স্তর’ মারাত্মকভাবে নিচে নেমে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা ঢাকা শহরে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার বিষয় উল্লেখ করতে পারি। ঢাকায় প্রতি বছর পানির স্তর ২ থেকে ৩ মিটার পর্যন্ত নিচে নেমে যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে আমাদের পানি উত্তোলনের জন্য গভীর থেকে গভীরতর স্তরে খনন করতে হচ্ছে। পানির স্তর অসীম নয়। এভাবে চলতে থাকলে একদিন, এ স্তর শুকিয়ে যাবে। আমাদের উত্তোলনের জন্য আর কোনো পানি থাকবে না। তখনই সত্যিকারের ভয়াবহ দুর্যোগ সংগঠিত হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গার্মেন্ট কারখানাগুলো এ পানি উত্তোলনের পর ব্যবহার করে নদী এবং খালে ফেলে দেয়। পোশাক উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরে, বিষাক্ত রাসায়নিক এবং রং পানিতে মিশে তা মারাত্মকভাবে অন্যান্য উৎসকে দূষিত করে। শুধু অল্প কয়েকটি কারখানায় কার্যকর ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট আছে। এছাড়া বাকিগুলোর অধিকাংশই কেবল নিরেট বিষ নিষ্কাষণ করে। মূলত পানি দূষণের জন্য ডাইং এবং ফিনিশিং প্ল্যান্টগুলো দায়ী। টঙ্গীর কারখানাগুলোর দূষিত পানি প্রবাহিত হয়ে তুরাগ নদী দূষণের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। দূষণে এই নদী প্রায় মৃত। এর পানি কালির মতো কালো দেখায় এবং এটি এমন এক ধরনের দুর্গন্ধ ছড়ায়, যাকে আক্ষরিক বলা যায় কোনো ব্যক্তি প্রতিবার শ্বাস নেয়ার সঙ্গে বিষ গ্রহণ করছেন।
এ পর্যবেক্ষণে মাধ্যমে দেখা যায়, টেক্সটাইল কারখানাগুলো ভূ-গর্ভস্থ পানির বিপুল ব্যবহার ও দূষণের জন্য প্রধানভাবে দায়ী। পুরনো ও অনেকটা অকার্যকর প্ল্যান্টগুলোতে অধিক পানি প্রয়োজন হয়। সেগুলোতে উৎপাদনের ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণ রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেশি রাসায়নিক ব্যবহার অর্থ আরও বেশি দূষণ। বাজারে বিদ্যমান প্রযুক্তি প্রয়োগ করে পানির ব্যবহার কমাতে পারে এ কারখানাগুলো। পাশাপাশি এর মাধ্যমে কারখানাগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাসায়নিকের ব্যবহার কমানো যায় এবং একই সঙ্গে দূষণও অনেক কমে আসবে। এছাড়াও, ডাইং এবং ফিনিশিং ইউনিটে প্রচুর পরিমাণ গ্যাস ব্যবহারের প্রয়োজন হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্যাস একটি অপর্যাপ্ত পণ্য। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে গ্যাস সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অকার্যকর প্ল্যান্টগুলো এ সংকট আরও বাড়িয়ে তুলছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক দেশ। প্রতি তিনজন ইউরোপিয়ানের মধ্যে একজন মেইড ইন বাংলাদেশ লেখা টি-শার্ট পরিধান করছে। প্রতি পাঁচজনে একজন আমেরিকান বাংলাদেশের তৈরি জিন্স পরেন। কিন্তু এই লাখ লাখ পোশাক উৎপাদন ও রফতানির পেছনে ভিন্ন গল্প রয়েছে। বাংলাদেশের কারখানাগুলোতে প্রতিটি জিন্স তৈরিতে দেশটিকে অতিরিক্ত ‘অদৃশ্য মূল্য’ দিতে হচ্ছে। একজন পশ্চিমা ক্রেতা খুব কমই জানেন একটি পোশাক উৎপাদনের সময় ধোয়া ও রং করার কাজে কি পরিমাণ মূল্যবান সম্পদ পানি ব্যবহার করা হয়।