বিশ্ববাজার প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা হারাচ্ছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। একদিকে বাড়ছে উৎপাদন খরচ, অন্যদিকে কমছে পোশাকের দর। একই সঙ্গে আবার বিশ্ববাজারে কমছে পোশাকের চাহিদা। গত দুই বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে ১৮ শতাংশের মতো। এ সময় প্রধান দুই বাজার ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে দর কমেছে গড়ে প্রায় ৭ শতাংশ। আর বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমেছে ৮ শতাংশ। এ তিন প্রতিকূলতায় সংকটে আছে প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক। এসব কারণে গত অর্থবছরে (২০১৬-১৭) পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিল্ফম্ন স্থানে।
বাংলাদেশের জন্য আরও দুঃসংবাদ হচ্ছে, পোশাক উৎপাদনে নতুন করে মনোযোগী চীন। শ্রম মজুরি বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক বছরে পোশাক উৎপাদন কমিয়ে আনে দেশটি। এতে চীনা প্লাস নীতির সুবাদে বাংলাদেশের প্রতি ক্রেতাদের বাড়তি আগ্রহ দেখা গেছে। তবে নতুন করে চীন আবার পোশাকে মনোযোগী হয়েছে। একজন শ্রমিক একসঙ্গে একাধিক মেশিন চালিয়ে নিতে পারেন এ রকম প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াচ্ছে চীনারা। সম্প্রতি প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির এক জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়, চীন এখনও ক্রেতাদের কাছে অপরিহার্য নাম।
বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পোশাকের দর কমেছে ৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। একক বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। চলতি বছরও এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে। গত জানুয়ারিতে ইইউতে দর কমেছে ৪ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে কমেছে ৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী জুলাই মাসেও দর কমেছে একই হারে।
বিশ্ববাজারে দর কমে আসার প্রবণতার বিপরীতে দেশে বেড়েই চলেছে উৎপাদন ব্যয়। বিজিএমইএর হিসাবে ২০১৬ সালে মজুরি বাবদ খরচ বেড়েছে ৩২ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিদ্যুৎ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। গ্যাসের জন্য বেড়েছে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি ৪০ শতাংশ ব্যয় বেড়েছে ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিংসহ (সিঅ্যান্ডএফ) পরিবহন খাতে। সব খাত মিলিয়ে গত দুই বছরে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে আগের বছরের তুলনায় ১৮ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। এর অতিরিক্ত সংস্কার বাবদ এককালীন মোটা অঙ্ক ব্যয় করেছেন উদ্যোক্তারা। বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, কারখানাপ্রতি গড় সংস্কার ব্যয় পাঁচ কোটি ৩০ লাখ টাকা। তবে এ খাতে কয়েকটি কারখানা সর্বোচ্চ ২০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচ করেছে। এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে পোশাকের চাহিদা কমে আসার প্রবণতা সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। ২০১৫ সালে পোশাকের চাহিদা আগের বছরের তুলনায় কমে ৮ শতাংশ। গত বছর আরও কমেছে ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অঙ্কের হিসাবের এসব ক্ষতি ছাড়াও নানা সংকটে রয়েছে পোশাক খাত। যেমন, নেতিবাচক প্রচারণা, চট্টগ্রাম বন্দরের স্থবিরতা, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পণ্য আনা-নেওয়ায় নানা সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী অবস্থান ইত্যাদি। টেক্সওয়েভের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশিকুর রহমান তুহিন এ প্রসঙ্গে সমকালকে বলেন, পোশাক খাতের জন্য সরকারের নেওয়া বিভিম্ন নীতির স্থিতিশীলতা না থাকার কারণেও সংকট চলছে। প্রতিবছর বাজেটে এ খাতের উৎসে কর বাড়ানো হয়। পরে আবার তা কিছুটা কমিয়ে আনা হয়। এর ফলে বিনিয়োগ নিয়ে প্রতিবছরই একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। তিনি বলেন, বিনিয়োগের আগে উদ্যোক্তারা সার্বিক পরিস্থিতির ওপর একটা সম্ভাব্যতা যাছাই শেষে বিনিয়োগ করে থাকেন। কিন্তু ছয় মাস-এক বছরের মাথায় নীতির পরিবর্তন হলে পুরো বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়ে সংকটে পড়েন তারা। পাঁচ কিংবা ১০ বছর মেয়াদি নীতি পরিকল্পনা নিলে উদ্যোক্তাদের জন্য সুবিধা হয়। তিনি বলেন, ভারতসহ প্রতিযোগী সব দেশ পোশাক খাতকে বিভিম্ন ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে। বাংলাদেশকেও টিকে থাকতে হলে সে পথেই এগোতে হবে। যেমন, রফতানিতে উৎসে কর আগামী দুই বছরের জন্য সম্পূর্ণ প্রত্যাহার এবং সব বাজারে ৫ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা চান তারা।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, গত অর্থবছরে পোশাকের রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। অথচ পরিমাণে রফতানি বেড়েছে। পোশাকের দর কমে আসার কয়েকটি কারণের মধ্যে রয়েছে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল এবং তুলাসহ অন্যান্য পোশাকের অন্যান্য কাঁচামালের দর কমে আসা। এতে হয়তো উদ্যোক্তারা কিছুটা সমল্প্বয় করে নিতে পেরেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পক্ষে পোশাকের বিশ্ববাজারে দরে প্রভাব খাটানোর সুযোগ নেই। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এখন কীভাবে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে এনে বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মেলানো যায় সেদিকেই মনোযোগ দিতে হবে।