দেশের বায়িং হাউসগুলোর কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মূলত বায়িং হাউসের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের জন্যই এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; যাতে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার ক্ষেত্র তৈরি করা যায়। এ লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা প্রণয়নেরও চিন্তা করছে সরকার। তাই এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রদানে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোঃ আবদুর রহিম খানকে (বস্ত্র) সভাপতি করে আট সদস্যের একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১ মাসের মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পেশ করার কথা বলা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রফতানিতে বায়িং হাউসগুলোর কার্যক্রম এবং তৈরি পোশাক রফতানি খাতে সৃষ্ট বাণিজ্য বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে যুগোপযোগী কার্যকর কর্মপন্থা নির্ধারণে গত মাসে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বলা হয়, তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) সঙ্গে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ’র প্রত্যক্ষ ভূমিকা বিবেচনায় বায়িং হাউসগুলোর সব কার্যক্রমে দায়বদ্ধতা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া এ সংক্রান্ত বাণিজ্য বিরোধ নিরসন করা দেশ-বিদেশেও দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। তাই বায়িং হাউসগুলোর কার্যক্রমে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার জন্য করণীয় নির্ধারণে এ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ অক্টোবর কমিটি গঠনের অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। এতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের টিও-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব সৈয়দা নাহিদা হাবিবা এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি), বাংলাদেশ ব্যাংক (বিবি), তৈরি পোশাক রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারাস অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ), নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচার অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ) ও বাংলাদেশ গার্মেন্ট বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিবিএ) একজন করে প্রতিনিধিকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। কমিটিকে তাদের কর্মপরিধিও ঠিক করে দেয়া হয়েছে। এগুলো হলোÑ বায়িং হাউসগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার লক্ষ্যে কোনো নীতিমালা প্রণয়ন করা যায় কিনা সে বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নসহ খসড়া পেশ এবং তাদের কিভাবে দায়বদ্ধ করা যায় সে বিষয়ে করণীয় সুপারিশসহ বাস্তবায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা।
এ বিষয়ে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশে বিদ্যমান বায়িং হাউসগুলোকে অবশ্যই নিয়ম-কানুন মেনে ব্যবসা করতে হবে। তাদের ক্রেতার পাশাপাশি গার্মেন্ট মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ করতে হবে। তারা বিশৃঙ্খলভাবে কাজ করলে পোশাক খাতের যে উচ্চ আয়ের লক্ষ্যমাত্রা সেটি পূরণ করা কঠিন হবে। তাই বায়িং হাউসগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ অবশ্যই সময়োপযোগী পদক্ষেপ। এটি দ্রুত তৈরি করে বাস্তবায়নে গেলে এ খাতের জন্য ইতিবাচক হবে। বাণিজ্য বিরোধে মতবিরোধ থাকলে সেটিও নিরসন হবে।
জানা গেছে, দেশে বিদ্যমান বায়িং হাউসগুলোর কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ও মনিটরিংয়ের জন্য ২০০২ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডিটিও দফতর থেকে একটি সার্কুলার জারি হয়। এতে বায়িং হাউসগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বিজিএমইএর অ্যাসোসিয়েট সদস্যপদ গ্রহণ এবং ইপিবি থেকে নিবন্ধিত হওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওই সার্কুলারের সমর্থনে বাংলাদেশ ব্যাংক একই বছরের ডিসেম্বরে এক পত্রে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪৭ এর ১৮ ধারায় বায়িং হাউসগুলোকে বিজিএমইএ এবং ইপিবি থেকে নিবন্ধিত হওয়ার নির্দেশনা প্রদান করে। কিন্তু বিজিবিএ এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে যায় এবং ওই সময় বাণিজ্য সচিব, ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান ও মহাপরিচালককে (বস্ত্র) বিবাদী করে হাইকোর্টে রিট মামলা দায়ের করে। বিজিবিএকে টিও লাইসেন্স প্রদান না করায় বাণিজ্য সচিবসহ আরও তিনজনকে বিবাদী করে পরে আরও একটি রিট মামলা করা হয়। এছাড়া বিজিবিএ বায়িং হাউসের কিছু সমস্যা সমাধানে আটটি সুপারিশ সংবলিত একটি পত্র ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা বরাবরে পেশ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে একই বছরের ২৮ মার্চ বাণিজ্য সচিবের সভাপতিত্বে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় তিনটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এগুলো হলোÑ গার্মেন্ট বায়িং হাউসগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বিজিএমইএ এবং ইপিবির নিবন্ধনের বিষয়ে বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারাধীন রিট পিটিশনটি শিগগিরই নিষ্পত্তির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ এবং বিশেষ করে বিজিবিএ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। বিজিবিএ সদস্যভুক্ত বায়িং হাউস এবং বিজিএমইএর সদস্যভুক্ত গার্মেন্ট রফতানিকারকদের মধ্যে কোনো বিরোধ সৃষ্টি হলে উভয় অ্যাসোসিয়েশন ঐকমত্যের ভিত্তিতে জরুরিভিত্তিতে সমাধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দেশের গার্মেন্ট বায়িং হাউসগুলোর বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে বিজিবিএ অবিলম্বে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ইপিবির প্রতিনিধি বলেন, তৈরি পোশাক খাতে ক্রেতা-বিক্রেতার মাধ্যমে প্রায়ই বাণিজ্যি বিরোধের অভিযোগ পাওয়া যায়; যার বড় অংশ বর্তমান অবস্থায় নিরসন করা সম্ভব হয় না। তিনি জানান, বাণিজ্য বিরোধগুলো ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্সের (আইসিসি) ইনকনটার্ম নীতির ভিত্তিতে পর্যালোচনা ও নিষ্পত্তি করা হয়। আইসিসির নীতি অনুযায়ী, এলসি খোলা, নবায়ন, নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ বায়িং হাউসগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। ফলে বাণিজ্য বিরোধের উদ্ভব হলে বায়িং হাউসকে দায়বদ্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দরকষাকষিতে দুর্বল বা অক্ষম রফতানিকারকরা সাধারণত এসব বায়িং হাউসের সেবা নিয়ে থাকে। ফলে নন-পেমেন্ট হয় এবং প্রতিষ্ঠানগুলো রুগ্ণ হয়ে পড়ে। কীভাবে বায়িং হাউসগুলোকে দায়দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা যায় তার উপায় নির্ধারণ করার ওপর জোর দেন তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি বলেন, বায়িং হাউসগুলোর বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আগে বিজিএমইএর এবং পরে সব পক্ষকে ডেকে সমাধান করা হতো। আইসিসি প্রণীত এলসি ট্রানজেকশনের নীতিমালা ইউসিপি-৬০০ অনুযায়ী, দ্বিতীয় পক্ষের কোনো দায়দায়িত্ব না থাকায় বায়িং হাউসগুলোকে নিয়ে কাজ করার জন্য একটি সফটওয়্যার ডেভেলপ করা হয়েছিল। অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানের অন্য নামে ব্যবসা করা প্রতিরোধে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পরে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বাতিল হলে এ বিষয়ে আর কোনো কার্যক্রম বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গ্রহণ করা হয়নি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রতিনিধি বলেন, প্রথমে বায়িং হাউসগুলোর ভ্যাট প্রদানের জন্য কড়াকড়ি করা হতো। পরে বায়িং হাউসগুলোর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হচ্ছে এবং তারা রফতানিতে সহায়তা করছে মর্মে যুক্তি দেখিয়ে ভ্যাট প্রদান থেকে অব্যাহতি পায়। এনবিআর কর্তৃক বিভিন্ন সেবার জন্য আলাদা আলাদা নীতিমালা করা হয়েছে। বায়িং হাউসের মতো ফ্রেইট ফরোয়ার্ড প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে। তাই বায়িং হাউসগুলোর কার্যক্রম তদারকির জন্যও এরূপ একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা যেতে পারে। এ বিষয়ে একটি মনিটরিং সেল গঠন করা যায় বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।