শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা শ্রম ও নিপুণ করিগরি ছোঁয়ায় এক খ- কাপড় ঝলমলে পোশাকে পরিণত হলেও বরাবরই অবহেলিত তারা। এ চিত্র গোটা বিশ্বের। নামিদামি ব্র্যান্ডের শোরম্নমে যে দামে পোশাক বিক্রি হয়, তার সামান্য অংশই যোগ হয় কারিগরদের হিসাবের খাতায়। অন্যের পরিচ্ছদ তৈরির করেও নিজেদের জীবন ধারণের নূ্যনতম অর্থও মেলে না তাদের। তবে অন্য দেশের তুলনায় এদেশের শ্রমিকদের মজুরির হার আরও তলানিতে। তাই দিন দিন জোরালো হচ্ছে পোশাক শিল্পের মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি। বর্তমানে এ শিল্পের সর্বনিম্ন হার ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এ হারের সময় উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি প্রকাশিত আন্ত্মর্জাতিক গবেষণা সংস্থা অক্সফাম-অস্ট্রেলিয়ার প্রতিবেদন এদেশে পোশাক খাতের নিম্ন মজুরির চিত্র আবারো মনে করিয়ে দিয়েছে। ‘হোয়াট শি মেকস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈশ্বিকভাবে বিক্রীত তৈরি পোশাকের মাত্র ৪ শতাংশ মজুরিতে ব্যয় হয়। তবে, বাংলাদেশে এর পরিমাণ বিশ্বের গড় হারের অর্ধেকেরও কম। এদেশে শ্রমিকদের মজুরিতে ২ শতাংশের কম অর্থ ব্যয় হচ্ছে। অর্থাৎ মজুরি পরিস্থিতি বাংলাদেশে তলানিতে।
এতে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে একজন শ্রমিকের ঘণ্টার নূ্যনতম মজুরি অস্ট্রেলিয়ার মুদ্রায় ৩৯ সেন্টের সমান, যা বাংলাদেশি টাকায় ২৪ টাকার সমান। অপর দিকে পোশাকের ক্ষেত্রে এদেশের প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনামে এর পরিমাণ ৬৪ সেন্ট বা ৪০ টাকা এবং চীনে ঘণ্টায় নূ্যনতম মজুরি ৯৩ সেন্ট বা ৬০ টাকার সমপরিমাণ। অর্থাৎ এদেশের শ্রমিকদের চেয়ে ভিয়েতনাম ও চীনের শ্রমিকরা দেড় থেকে আড়াইগুণ বেশি মজুরি পায়।
অপর দিকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে করা আন্ত্মর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদন মতেও শুধু মজুরি অংকই নয় মজুরি বৃদ্ধির হারেও বাংলাদেশে নিচের দিকে অবস্থান করছে। এমনকি গত তিন বছরে বাংলাদেশে যে হারে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে, তার চেয়ে বেশি হারে বেড়েছে পোশাক রপ্তানিতে প্রতিযোগী দেশ ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে। এছাড়া চীনে প্রকৃত মজুরি বাড়ছে অনেক বেশি হারে।
আইএলও-র ‘ফ্ল্যাগশিপ’ প্রতিবেদন ‘গেস্নাবাল ওয়েজ রিপোর্ট ২০১৬/২০১৭: ওয়েজ ইনইকুয়ালিটি ইন ওয়ার্ক পেস্নসে’ বলা হয়েছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত্ম বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি বেড়েছে মোট ১১ শতাংশ। অন্যদিকে ভারতে তা ১৬ দশমিক ৩, ভিয়েতনামে ১২, কম্বোডিয়ায় ৪৪ দশমিক ৩ (দুই বছরে), থাইল্যান্ডে ১৬ দশমিক ৯ ও চীনে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ হারে বেড়েছে।
অপর দিকে ‘পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি-২০১৫’ শীর্ষক আরেক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পোশাক খাতে নিম্নতম মজুরি মাসে ৬৮ ডলার, ভারতে ৭৮ ডলার, ইন্দোনেশিয়ায় ৯২ ডলার, পাকিস্ত্মানে ৯৯ ডলার, কম্বোডিয়ায় ১২৮ ডলার ও মালয়েশিয়ায় ২২৫ ডলার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো চাইলে দারিদ্র্যপীড়িত শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো সম্ভব। এক্ষেত্রে পোশাকের বিক্রি মূল্যের মাত্র এ শতাংশ বাড়ালেই তা শ্রমিকদের মজুরি প্রায় দ্বিগুণে উন্নীত করতে পারে। এতে তাদের খাদ্য, বস্ত্র, স্বাস্থ্য পরিষেবা, যোগাযোগের ব্যয় বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানো সম্ভব হয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, তৈরি পোশাক খাতের বর্তমান যে মজুরি তা বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় অনেক কম। সর্বশেষ এ খাতের মজুরি বেড়েছিল প্রায় তিন বছর আগে। তবে এ সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতিসহ সার্বিক দিক বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে এ মজুরি নিতান্ত্মই অপ্রতুল। এজন্য মজুরি বৃদ্ধির বিষয়টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আলোচনার দাবি রাখে।
শ্রমিক নেতারা বলছেন, গত দুই বছরে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। তাহলেও শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হবে না। ২০১৩ সালের পর থেকে গত ৩ বছরে প্রত্যেক শিল্প এলাকায় বাড়ি ভাড়া বেড়েছে, অথচ শ্রমিকের মজুরি বাড়েনি। বিদু্যৎ এবং গ্যাসের দাম কয়েক দফা বেড়েছে মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে পণ্যের উপর। যানবাহনের ভাড়া বেড়েছে। যার প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শিকার শ্রমিকশ্রেণি। ফলে তিন বছর আগে নির্ধারণ করা বেতনে শ্রমিকের জীবনযাপন অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি অ্যাডভোকেট মণ্টু ঘোষ বলেন, ২০১৩ সালে যখন মজুরি বৃদ্ধি করে তখন চালের কেজি ছিল ২০ থেকে ২৫ টাকা। এখন বাজারে প্রতি কেজি চালের মূল্য ৬০ টাকার উপরে। বেড়েছে সব ধরনের খরচ। কিন্তু শ্রমিকদের মজুরি বাড়েনি। বর্তমানে যা মজুরি শ্রমিক পায় তা দিয়ে আর চলছে না। অনতিবিলম্বে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান মজুরি কাঠামো অনুসারে, নূ্যনতম মজুরির (৫৩০০ টাকা) মধ্যে মূল মজুরি ৩০০০ টাকা, বাসা ভাড়া ১২০০ টাকা, চিকিৎসা খরচ ২৫০ টাকা, যাতায়াত খরচ ২০০ টাকা এবং খাদ্যভাতা ৬৫০ টাকা। কিন্তু এ টাকায় কিছুই সম্ভব নয়। ১২০০ টাকা দিয়ে বাড়ি ভাড়া কোনো শিল্প অঞ্চলে পাওয়া সম্ভব নয়। তেমনি চিকিৎসা ভাতা, টিফিন ভাতা এবং মূল বেসিক বেতন সবই বাস্ত্মবের এবং প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। চিকিৎসা ভাতা ২৫০ টাকা মাত্র। যাতায়াত ভাতা ২০০ টাকা মাত্র। কারখানায় আসা-যাওয়ায় সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা করে ধরলেও দিনে যাতায়াত খরচ ২০ টাকা, ২৬ কর্মদিবসে কমপক্ষে ৫২০ টাকা লাগে। তাই মজুরি বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই।
এদিকে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে স্বোচ্চার হচ্ছে বিভিন্ন শ্রমিক অধিকার সংগঠন। এ লক্ষ্যে শ্রমিক অধু্যষিত এলাকায় কিছু সংগঠন শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের মতামতও নিচ্ছে। ইতোমধ্যে পোশাক শিল্প মালিকদের একাধিক সংগঠন বিজিএমইএ ও শ্রম মন্ত্রণালয়কে মজুরি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে চিঠিও পাঠিয়েছে। সর্বশেষ ইন্ডাস্ট্রিয়াল বাংলাদেশ কাউন্সিল (আইবিসি) দ্রম্নত মজুরি বোর্ড পুনর্গঠনের দাবিতে বিজিএমইএতে চিঠি পাঠিয়েছে।