চুয়াডাঙ্গার সুমি বেগম কাজ করছেন গাজীপুরের বী-কন নিটওয়্যার লিমিটেডে (ফ্যাক্টরি-২)। বর্তমানে মেশিন অপারেটর হিসেবে তাঁর বেতন হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার টাকা। তবে এই বেতন পাওয়ার আগে কারখানার ভেতরেই সুমিকে প্রশিক্ষণে অংশ নিতে হয় তিন মাস। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত চলে প্রশিক্ষণ। প্রশিক্ষণের আগে সুমির কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও প্রশিক্ষণের সময় বেতন পেয়েছেন ৫ হাজার ৩০০ টাকা। এক বছরের একটু বেশি সময় ধরে কাজ করছেন সুমি।
সুমিসহ অন্য শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তিন মাস প্রশিক্ষণ শেষ হলেও শ্রমিকদের নজরদারির আওতায় রাখা হয়। দক্ষতা দেখাতে পারলে মেশিন অপারেটর হিসেবে শ্রমিকদের বেতন বেড়ে ৭ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
প্রশ্ন আসতে পারে, সুমিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কারখানার লাভটা কী হলো? এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন মেট্রো নিটিং অ্যান্ড ডাইং মিলস লিমিটেডের অধীনে পরিচালিত এই কারখানার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত প্রতিনিধিরা। মেট্রোর মহাব্যবস্থাপক (অ্যাডমিন, এইচআর ও কমপ্লায়েন্স) আতিকুল ইসলাম বলেন, শুধু সুমি নন, প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া শ্রমিকদের দিয়ে এই তিন মাস কারখানার কোনো লাভ হচ্ছে না। কারখানার ভেতরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনার খরচ, কারখানায় প্রশিক্ষণের জন্য জায়গাটুকুও ছেড়ে দিতে হচ্ছে। প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর অনেকেই অন্য কারখানায় চলে যাচ্ছেন। কিন্তু লাভ তো অবশ্যই আছে। একজন দক্ষ শ্রমিকের কাছ থেকে যে কাজ পাওয়া যায়, তা অদক্ষ শ্রমিকের কাছ থেকে পাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না। শ্রমিক অন্য কারখানায় চলে গেলেও লাভ হচ্ছে এই শিল্পেরই।
গত ২ নভেম্বর গাজীপুরের সালনায় অবস্থিত বী-কন নিটওয়্যারে গিয়ে সুমির সঙ্গে কথা হয়। তাঁর কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস—‘এই পেশায় আসার ফলে আমি এখন স্বাধীন। স্বামীর কাছে কোনো কিছুর জন্য আর হাত পাততে হয় না।’ সংসারটা আর একটু গুছিয়ে সন্তান নেবেন বলেও জানালেন।
বী-কনের প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিতে আসা কুমিল্লার ইয়াসমিন জানালেন, তিনি কারখানার গেটে এসেছিলেন কাজের জন্য। তারপর প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। বেতন পাচ্ছেন ৫ হাজার ৩০০ টাকা।
বী-কনের কর্মকর্তারা জানান, এ পর্যন্ত ১০ ব্যাচে বী-কনের ৪২৯ জন শ্রমিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষে বী-কনে বাড়তি বেতনে কাজ করছেন ৩২৮ জন।
বী-কনসহ দেশের পোশাকশিল্পের ১০টি কারখানা তার কর্মীদের জন্য কারখানার ভেতরে প্রশিক্ষণকেন্দ্র পরিচালনা করছে। প্রশিক্ষণ খাতে কারখানার নিজস্ব বিনিয়োগের পাশাপাশি সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর বাংলাদেশ অ্যাপারেল ইন্ডাস্ট্রি (সিবাই) কর্মীদের প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করছে। ২০১৪ সালে সিবাই ইনস্টিটিউট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), সুইডিশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক পোশাক বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান হেননেস অ্যান্ড মাওরিৎসের (এইচঅ্যান্ডএম) সহযোগিতায় বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে এই ইনস্টিটিউট। তবে চলতি মাসেই সিবাইয়ের কার্যক্রমের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা।
সিবাইয়ের একটি কার্যক্রম হচ্ছে এন্টারপ্রাইজ বেইজড ট্রেনিং বা ইবিটি। কার্যক্রমটির আওতায় কারখানার ভেতরে প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হচ্ছে। ইবিটি সেন্টারগুলো সরকারের কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নিবন্ধিত প্রশিক্ষণপ্রতিষ্ঠান এবং এগুলোতে জাতীয় শিক্ষার মানদণ্ড অনুযায়ী প্রশিক্ষণ পরিচালনা করা হচ্ছে।
গত ২ নভেম্বর আইএলও কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকে গাজীপুর ও সাভারের আশুলিয়ায় সিবাইয়ের কার্যালয় পরিদর্শন করার সুযোগ করে দেয়। সিবাইয়ের কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, এখানেও পোশাকশিল্পে কাজ করার জন্য শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এখান থেকে প্রশিক্ষণ পাওয়া শ্রমিকেরা কারখানায় গিয়ে সরাসরি মেশিন অপারেটর হিসেবে কাজে যোগ দেবেন। এই কর্মীদের হেলপার হিসেবে আর কাজ শুরু করতে হবে না। এই ইনস্টিটিউট পোশাক কারখানার উন্নয়ন ও কাজের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য জাতীয় দক্ষতানীতি ২০১১-এর আওতায় স্বীকৃত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে, যাতে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ ও মজুরি বৃদ্ধি পায়। প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য কার্যক্রম বাস্তবায়নে ন্যাশনাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ভকেশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক (এনটিভিকিউএফ) কঠোরভাবে অনুসরণ করা হয়। প্রশিক্ষণের পর মূল্যায়ন পর্বে পাস করার পর এই কর্মীরা হাতে পান দক্ষতার সরকারি সনদ, যা দিয়ে তাঁরা দেশে ও দেশের বাইরে গিয়ে কাজ করার সুযোগ পান।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত সিবাইয়ের অধীনে (১০টি কারখানার শ্রমিক) প্রশিক্ষণ শেষ করে প্রায় ৫ হাজার ৭৬৩ জন শ্রমিক বিভিন্ন পোশাক কারখানায় বিভিন্ন পদে কাজ করছেন। সুপারভাইজার পর্যায়ের ৬৩ জন কর্মকর্তাও এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
সিবাইয়ের সিইও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আফতাব উদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে পোশাকশিল্প কারখানায় দক্ষ শ্রমিকের অভাব আছে। সিবাই কাগজে-কলমে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হয় গত বছরের জুলাই মাসে। এ ইনস্টিটিউট প্রশিক্ষণের একটি মানদণ্ড তৈরি করার চেষ্টা করছে।
সিবাইয়ের আওতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক একটি গবেষণা ও উন্নয়ন শাখা রয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসা কৌশল, কারখানা স্থানান্তরের কৌশল, তৈরি পোশাক খাতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মক্ষেত্রের উন্নয়ন, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিসহ কিছু বিষয় গবেষণার জন্য চিহ্নিত করা হলেও গবেষণা কার্যক্রম সেভাবে শুরু হয়নি বলে জানান আফতাব উদ্দীন আহমদ।
বিভিন্ন কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদেরও সিবাই কার্যালয়ে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হচ্ছে। অপারেটর হিসেবে কর্মরত মিলন হোসেন জানালেন, কারখানা থেকেই তাঁকে এখানে পাঠানো হয়েছে, তবে বেতন থেকে কারখানা ৫ হাজার টাকা কেটে রাখছে।