দেশের সর্ববৃহৎ বড় অর্থনৈতিক জোন মিরসরাইয়ে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য ৫০০ একরের আলাদা ব্লক বরাদ্দে সদস্যদের কাছ থেকে আগ্রহের পাশাপাশি তারা বুকিং মানির অগ্রিম টাকা জমা দিতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে তৈরি পোশাক মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ঢাকা ও চট্টগ্রামের শতাধিক প্রতিষ্ঠান সর্বমোট ৩৯১ একর জমির জন্য বিজিএমইএর কাছে আবেদন জমা দিয়েছে।
এর মধ্যে শর্ত মোতাবেক ৬৩ একরের জন্য অগ্রিম হিসেবে ১৫ কোটি ৭৫ লাখ টাকাও জমা দিয়েছে একাধিক সদস্য। অগ্রিম টাকা জমা দেওয়ার শেষ সময় গত ২ নভেম্বর পেরিয়ে গেলেও সদস্যদের সুবিধার্থে এই সময় আরো কিছুদিন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজিএমইএ পরিচালনা পর্ষদ।
তবে আগ্রহ দেখানোতে ব্যাপক উৎসাহ লক্ষ করা গেলেও বুকিং মানি দেওয়ার বেলায় ‘ধীরে চলো’ নীতিতে আছে ব্যবসায়ীরা। ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ পর্যন্ত হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবিত বুকিং মানি জমা দিয়েছে বলে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে।
বিজিএমইএ চট্টগ্রাম অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৯১ একর জমির মধ্যে মেসার্স কাট্টলী টেক্সটাইল লিমিটেড এককভাবে ৫০ একর জমির জন্য বিজিএমইএর মাধ্যমে আবেদন করেছে। এ ছাড়া আজিম গ্রুপের পক্ষ থেকে ২০ একর জমির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি ১২১ একরের জন্য আবেদন করেছে ৬১টি বিজিএমইএ প্রতিষ্ঠান।
বিজিএমইএ সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান স্বাক্ষরিত সার্কুলারে সাত দিনের মধ্যে সদস্যদের আগ্রহের বিষয়টি জানতে চাওয়া হলেও পরবর্তী সময়ে গুরুত্বের বিষয়টি অনুধাবন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বুকিং মানি দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। বিপত্তিটা বাধে এই বুকিং মানি নিয়ে।
অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি প্লট এক একর। প্রতি প্লটের প্রস্তাবিত মূল্য এক কোটি টাকা, যা কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য। এই জমি ৫০ বছরের জন্য লিজ হিসেবে দেওয়া হবে। আগ্রহী প্রতিষ্ঠানকে বুকিং মানি হিসেবে শুরুতে প্রতি একরের জন্য ২৫ লাখ টাকা করে দিতে হবে। কিন্তু যারা আবেদন করেছে তাদের অনেকেই অগ্রিম টাকা দেওয়ার আগে আরো চিন্তা-ভাবনা করতে চায়। কারণ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার আশঙ্কা করছে তারা।
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বুকিং মানি জমা পড়েছে চট্টগ্রামের সদস্যদের কাছ থেকে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের ১৫টি প্রতিষ্ঠান ৪৬ একর জমির জন্য সাড়ে ১১ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। এর মধ্যে গত ২৫ অক্টোবর ছয় একরের প্লটের জন্য দেড় কোটি অগ্রিম জমা দিয়েছে আরডিএম অ্যাপারেলস। এ ছাড়া পাঁচ একর করে দুটি প্লটের জন্য গত ২ নভেম্বর আড়াই কোটি টাকা জমা দিয়েছে ক্লিফটন গ্রুপ। একইভাবে ফোর এইচ গ্রুপও তাদের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে পাঁচ একর করে দুটি প্লটের জন্য আড়াই কোটি টাকা বিজিএমইএতে জমা দিয়েছে।
ঢাকা থেকেও সাতটি প্রতিষ্ঠান ১৭ একর শিল্প প্লটের জন্য চার কোটি ২৫ লাখ টাকা জমা দিয়েছে বলে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে।
বন্দরনগরীর রাহাত্তার পুল এলাকার আরডিএম অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রকিবুল আলম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সব কিছু বিবেচনায় নিলে মিরসরাই ইকোনমিক জোনে এ ধরনের একটি উদ্যোগ নেওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। এটা অনেক ইপিজেডের আদলে হবে। এখানে গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, কেন্দ্রীয় ইটিপিসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। এত কম দামে এই ধরনের প্লট পাওয়া যাবে না। তাই আমরা আবেদনের পাশাপাশি প্রস্তাবিত বুকিং মানি পরিশোধ করে আমাদের দাবি তুলে ধরেছি। ’ তবে প্লট বুঝিয়ে দেওয়ার সময় পাঁচ বছর থেকে আরো কমিয়ে আনা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক একরের প্লটের জন্য আবেদনের পাশাপাশি নির্ধারিত বুকিং মানিও জমা দিয়েছে বিএলপি ওয়ার্ম ফ্যাশন লি.। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘মুরাদপুরে অবস্থিত আমার স্যুয়েটার ফ্যাক্টরিতে ২০১৮ সালের পর আর উৎপাদন কার্যক্রম চালু রাখা যাবে না। এ কারণে চট্টগ্রামের আনোয়ারায় ২৭ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে নতুন কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। কিন্তু সেখানে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র পেতেই ছয় মাস লেগে গেছে। কারখানা চালু করতে সম্ভাব্য আরো ২ বছর সময় লাগবে। তাই ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই মিরসরাইয়ে কিছু জায়গার জন্য বুকিং দিয়ে রাখলাম। ’
তবে চট্টগ্রাম থেকে যতগুলো আবেদন জমা পড়েছে তা উৎসাহব্যঞ্জক নয় বলে মনে করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি এবং ইস্টার্ন অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাছির উদ্দিন চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘শিল্প জোনটা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের জন্য বেশি সুবিধাজনক। কিন্তু সে হিসেবে সাড়া পড়েনি। এটা আসলে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনার বিষয়। পাঁচ বছর পর দেশের গার্মেন্ট শিল্পের অবস্থা কেমন হবে সেটা নিয়েও অনেকে চিন্তিত। তা ছাড়া এত টাকা দীর্ঘ সময় ফেলে রাখবে কি না সেটাও বিবেচনার বিষয়। ’ নতুন এই উদ্যোগে নতুন উদ্যোক্তাদের আগ্রহ বেশি থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
তবে বিজিএমইএ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর স্বল্প সময়ের নোটিশে শুধু চট্টগ্রাম থেকে ১৯১ একরের জন্য আবেদন জমা পড়াটাকে সন্তোষজনক হিসেবেই দেখছেন। অগ্রিম টাকা জমা দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আসলে টাকা জোগাড় করার একটা বিষয় আছে। এমনিতে গার্মেন্ট সেক্টর সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা মন্দা যাচ্ছে। সেখানে হুট করে এত টাকা জোগাড় করা কষ্টসাধ্য। কিন্তু এর পরও সদস্যরা চেষ্টা করছে টাকা জমা দিতে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘সদস্যরা যত দ্রুত বুকিং মানি জমা দেবে আমরা তত তাড়াতাড়ি বেজার সঙ্গে চুক্তিতে যেতে পারব। এতে জমি বরাদ্দ পাওয়ার ক্ষেত্রেও আমরা এগিয়ে থাকব। ’ আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বুকিং মানির পরিমাণ আরো বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।