Home Bangla Recent ফাটল আতঙ্ক এখনো কাটেনি

ফাটল আতঙ্ক এখনো কাটেনি

৪ জানুয়ারি, ২০১৭। রাজধানীর একটি পোশাক কারখানার ১২ জন শ্রমিকের টেলিফোন বার্তা পায় অ্যালায়েন্স। সবগুলো বার্তাই ছিল ভবনের ফাটলসংক্রান্ত। ফাটলের খবরে আতঙ্কিত হয়ে বার্তাগুলো পাঠিয়েছিলেন তারা।

শুধু ফাটল নয়, কর্মপরিবেশ নিয়ে অন্যান্য আতঙ্কের বার্তাও পাঠাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা। অগ্নি, স্থাপত্য কম্পন, তালাবদ্ধ বহির্গমন ও শর্ট সার্কিট এর মধ্যে অন্যতম। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে গেছে ফাটল আতঙ্ক। চলতি মাসে প্রকাশিত অ্যালায়েন্সের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৭-এর তথ্য বলছে, গত তিন বছরে পোশাক শ্রমিকরা যেসব আতঙ্কের কথা জানিয়ে জরুরি টেলিফোন বার্তা পাঠিয়েছেন তার প্রায় ৩৩ শতাংশ ফাটলসংক্রান্ত।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানার মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করে উত্তর আমেরিকাভিত্তিক ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স সেফটি। মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরুর পর পরই হেল্পলাইন চালু করে অ্যালায়েন্স। হেল্পলাইনের নির্দিষ্ট নম্বরে নিরাপত্তাজনিত যেকোনো বিষয় সরাসরি জানানোর সুযোগ রয়েছে শ্রমিকদের। অ্যালায়েন্সের আওতায় থাকা ৯৪১টি কারখানার শ্রমিকরা নিয়মিত তাদের আতঙ্কের কথা টেলিফোনের মাধ্যমে জানাচ্ছেনও। ২০১৪-এর ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত শ্রমিকদের পাঠানো জরুরি টেলিফোন বার্তার একটি শ্রেণীবিন্যাস করেছে অ্যালায়েন্স। এতে ফাটল আতঙ্ক রয়েছে সবার ওপরে।

২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধস নাড়িয়ে দেয় গোটা পোশাক শিল্পকেই। কারখানা মূল্যায়নকারীরা বলছেন, ভবন ধসের ওই আতঙ্ক এখনো রয়ে গেছে শ্রমিকদের মধ্যে। ছোটখাটো ফাটল দেখলেও জরুরি ফোনকলের মাধ্যমে তার প্রকাশ ঘটাচ্ছেন তারা।

রাজধানীর মিরপুর এলাকার পৃথক তিনটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন মিতা, শরিফ ও করিম। তিনজনের কর্মস্থলই ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলা। রানা প্লাজা ধসের পর এদের একজন বছরখানেক পোশাক কারখানায় কাজ থেকে বিরত ছিলেন। এরপর কাজে যোগ দিলেও আতঙ্ক থেকে বেরোতে পারেননি। বাকি দুজনের ভাষ্য, কারখানায় ছোটখাটো কম্পন বা ফাটল দেখলে এখনো ভীতি কাজ করে তাদের মধ্যে।

অ্যালায়েন্সের প্রতিবেদনও বলছে, গত তিন বছরে নিরাপত্তা নিয়ে শ্রমিকদের জরুরি ফোনকলের ৩২ দশমিক ৮৫ শতাংশ ছিল ভবনের ফাটলসংক্রান্ত। এর পরই শ্রমিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আতঙ্ক আগুনসংক্রান্ত। এ ধরনের জরুরি কল ছিল ২৪ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এছাড়া কম্পনসংক্রান্ত আতঙ্কের কথা জানিয়ে ফোনকল ছিল ১৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এর বাইরে তালাবদ্ধ বহির্গমন নিয়ে জরুরি কল ছিল ১৪ দশমিক ৫১, অগ্নিঝুঁকিসংক্রান্ত ৩ দশমিক ৭২ ও বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ বা শর্ট সার্কিট নিয়ে ১ দশমিক ৪ শতাংশ। বৈদ্যুতিক তার ও অননুমোদিত সাব-কন্ট্রাক্টিং সংক্রান্ত আতঙ্কসংবলিত টেলিফোন বার্তার হার ছিল যথাক্রমে দশমিক ৮৪ ও দশমিক ১২ শতাংশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, যে কারখানায় দুর্ঘটনা ঘটে, সে কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে বহুদিন পর্যন্ত আতঙ্ক থাকাটাই স্বাভাবিক। রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনার শিকারদের মানসিক আঘাত আমৃত্যু থেকে যাওয়ার কথা। তবে অন্যান্য কারখানার শ্রমিকদের আতঙ্ক এখনো কাটছে না কেন, তা অনুধাবন করাটা জটিল। সচেতন শ্রমিকদের আতঙ্কিত হওয়ার কথা নয়। কোনো দুর্ঘটনার ইঙ্গিত পেলে তা মোকাবেলার ব্যবস্থা নেয়াই সচেতন শ্রমিকদের কাজ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।

তবে শ্রমিকদের এ আতঙ্কের যে যথেষ্ট কারণ আছে, তা উঠে এসেছে দেশের পোশাক খাত মূল্যায়নে নিয়োজিত আরেক ক্রেতা জোট ইউরোপভিত্তিক অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটির প্রতিবেদনে। তাদের আওতাধীন ১ হাজার ১৫টি কারখানা ভবনের ভার বহনক্ষমতার ঘাটতি শনাক্ত করে অ্যাকর্ড। গত মাসে প্রকাশিত জোটের সর্বশেষ প্রান্তিক প্রতিবেদন বলছে, ৪০টি কারখানায় এ ঘাটতি এখনো রয়ে গেছে। এছাড়া ভবনের পরিকল্পনা ও নকশায় অসামঞ্জস্যতা শনাক্ত হয়েছে ৯৯২টি কারখানায়। এ অসামঞ্জস্যতা নিয়েই এখনো চলছে ৪৪৬টি কারখানা।

এসব কারণেও শ্রমিকরা সহজে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন বলে জানান শ্রমিক প্রতিনিধিরা। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, ক্রেতা জোটগুলো যে মূল্যায়ন কার্যক্রম চালাচ্ছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে কারখানার ত্রুটি এখনো রয়ে গেছে। তাহলে আতঙ্ক কীভাবে কাটবে? এ আতঙ্ক কাটানোর উদ্যোগ মালিকদেরই নিতে হবে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি শ্রমিকদের কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এসবের মধ্য দিয়ে পর্যায়ক্রমে শ্রমিকদের মধ্য থেকে আতঙ্ক দূর করা সম্ভব।

জরুরি কলের মাধ্যমে ক্রেতা জোটকে অবহিত করার বিষয়টিকে শ্রমিকদের আতঙ্ক না বলে সচেতনতা বলতেই বেশি আগ্রহী তৈরি পোশাক শিল্প মালিকরা। এ খাতের সংগঠন বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এসএম মান্নান কচি বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আমরা ব্যাপক সংস্কার কার্যক্রম চালিয়েছি। এ কার্যক্রম এখনো অব্যাহত আছে। কারখানা মালিকরাও এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। এ সচেতনতা আছে শ্রমিকদের মধ্যেও। তাই জরুরি কলের মাধ্যমে ক্রেতা জোটকে অবহিত করার বিষয়টিকে শ্রমিকদের আতঙ্ক নয়, বরং সচেতনতা বলেই আমি মনে করি। তবে এটাও ঠিক, শ্রমিকদের আতঙ্ক সবসময় সঠিক নয়। বহিরাগতদের ইন্ধনেও কখনো কখনো আতঙ্ক প্রকাশ করেন তারা।

পোশাক শ্রমিকরা স্থাপনাগত ত্রুটির সবচেয়ে বড় শিকার হন ২০১৩ সালে। সাভারের রানা প্লাজা ধসে প্রাণ হারান সহস্রাধিক শ্রমিক। বৈশ্বিক শিল্প দুর্ঘটনার ইতিহাসে এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় বিপর্যয়। ধসে পড়ার আগে ভবনটিতে ফাটলও দেখা দেয়। একপর্যায়ে ভার সইতে না পেরে ধসে পড়ে। সেই আতঙ্ক এখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে পোশাক শিল্প শ্রমিকদের।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here