অসদাচরণের জন্য ছাঁটাইকৃত ৯ জন নেতাসহ ৪৪ জন শ্রমিককে চাকরিতে বহাল করতে চট্টগ্রামের সাগরিকায় অবস্থিত সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের (এসবিএল) কারখানা বন্ধের হুমকি দিলেন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতাদের সংগঠন ‘অ্যাকর্ড’-এর বাংলাদেশ প্রধান। অ্যাকর্ড ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েসের দাবি বাস্তবায়ন করা না হলে একই গ্রুপের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে নন-কমপ্লায়েন্স করে অ্যাকর্ডভুক্ত ২২০টি ব্র্যান্ডের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করার হুমকিও দিয়েছেন তিনি।
এর ফলে কারখানা চালু রাখা নিয়ে বিপাকে পড়েছে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এসবিএলকে ঘিরে রব ওয়েসের কর্মকাণ্ডে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতাদের হারানোর আশঙ্কা করছেন তাঁরা। আর অ্যাকর্ডের এই হুমকিতে অনিশ্চয়তায় পড়েছে ৩১ বছরের পুরনো সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেডের প্রায় ১২ হাজার শ্রমিক।
কারখানা কর্তৃপক্ষ, শ্রমিক এবং বিজিএমইএর নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শ্রমিক নেতৃত্ব নিয়ে গ্রুপিংয়ের কারণে ৫-৬ মাস আগে এসবিএল কারখানা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি হয়। এই শ্রমিক ইউনিয়নটি মূলত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শ্রমিক সংগঠন আইটিজিএলডাব্লিউএফের সহযোগী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ফেডারেশন (বিগাফ) সমর্থিত। এ সময় সাধারণ শ্রমিকদের সমর্থন হারিয়ে ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ওসমানের নেতৃত্বে ৯ জন নেতাসহ ৪৪ জন শ্রমিক কারখানায় কয়েক মাস ধরেই অনুপস্থিত আছেন। এ নিয়ে অনুপস্থিত নেতারা বিগাফের মাধ্যমে অ্যাকর্ডের কাছে অভিযোগ দিয়েছেন। এই অভিযোগের ভিত্তিতে অ্যাকর্ড দফায় দফায় এসবিএল কর্তৃপক্ষকে তাদের পুনর্বহাল করার জন্য বলেন। গত ১২ নভেম্বর এক দফা চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পুনর্বহালের জন্য চেষ্টা করা হলে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করে।
পরে পুলিশের সহায়তায় তাদের কারখানা থেকে বের করে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়।
এরই ধারাবাহিকতায় গত ২ নভেম্বর অ্যাকর্ড ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েস চট্টগ্রামে এসে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে তিনি চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের পনুর্বহাল করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কর্তৃপক্ষ কারখানার প্রায় ৩ হাজার শ্রমিকের অপছন্দের বিষয়টি তুলে ধরলে একপর্যায়ে এই ৪৪ শ্রমিককে পুনর্বহাল করা না হলে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ইউনিট-২সহ অন্য আরো ৫টি কারখানাও নন-কমপ্লায়েন্স করা হবে বলে হুমকি দেন। একই সঙ্গে অ্যাকর্ডভুক্ত ২২০টি ব্র্যান্ড যেন এই কারখানাগুলোতে কাজ করতে না পারে সে ব্যবস্থা করবেন বলে জানান। মালিক পক্ষের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি দোভাষীর মাধ্যমে শ্রমিকদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে গেলে শ্রমিকদের প্রবল বিরোধিতার মধ্যে পড়েন।
শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ না থেকে ৩ নভেম্বর রবিবার নিজেই চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের ২৫ জনকে সঙ্গে নিয়ে কারখানায় চলে আসেন। এ সময় টের পেয়ে কারখানার প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক নিচে নেমে এসে তাদের একটি কক্ষে আটক করে রাখে। খবর পেয়ে সিএমপি পুলিশ, শিল্প পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। এ সময় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা কারখানায় কিছু ভাঙচুর চালায়। পরে পুলিশি নিরাপত্তার মধ্যে রব ওয়েসসহ চাকরিচ্যুত শ্রমিকদের সেখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বার্ষিক ১০ মিলিয়ন পিস উৎপাদন ক্ষমতার ওভেন কারখানায় গতকাল কোনো উৎপাদন কার্যক্রম ছিল না।
পুরো বিষয়টি নিয়ে প্রতিষ্ঠানের অন্যান্য বায়াররাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক বায়ার প্রাইমার্ক, নেক্সট, চিলড্রেন প্লেস কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করতে দফায় দফায় সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্স লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ই-মেইল করে পরিস্থিতি তুলে ধরছেন।
চাকরিচ্যুত এবং ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ ওসমান এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত ১ জুন সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের অন্য প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ডেনিম কারখানাটি লে-অফকে ইস্যু ধরে আমরা যারা ইউনিয়ন করি তাদের নির্যাতন করা হয়। এরপর থেকে আমরা কারখানায় যেতে পারি না। এ নিয়ে অ্যাকর্ডের মধ্যস্থতায় কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের মধ্যে চুক্তিও হয়েছে। এর ভিত্তিতে আমরা রবিবার কাজে যোগদান করতে গেলে আমাদের ওপর বহিরাগতরা হামলা চালায়। ’
তবে সেলিম অ্যান্ড ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মামুন সালাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অ্যাকর্ড বেআইনিভাবে শ্রমিকদের নিজস্ব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে আমার কারখানাকে অস্থিতিশীল করছে। এই বিগাফ নামের শ্রমিক সংগঠনের অত্যাচারে ঋণখেলাপি হয়ে ৬ মাস আগে ৭০০০ শ্রমিকের একটি কারখানা লে-অফ করতে বাধ্য হয়েছি। এই শ্রমিকদের চাকরিতে পুনর্বহাল নিয়ে আমাদের ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাদের বলেছি, যেহেতু অধিকাংশ শ্রমিক চাচ্ছে না আমাদের অন্য কারখানায় তাদের চাকরির ব্যবস্থা করে দিই। কিন্তু সেটাও মানছে না। অ্যাকর্ডের এই বিষয়টি আমরা বিজিএমইএ কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ’
এ বিষয়ে জানার জন্য অ্যাকর্ডের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে ই-মেইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
রবিবারের ঘটনার শুরু থেকেই ঘটনাস্থলে থাকা শিল্প পুলিশ চট্টগ্রাম জোনের সহকারী পরিচালক কামরুল হাসান ঢাকায় শিল্প পুলিশ প্রধানকে পাঠানো পর্যবেক্ষণে অ্যাকর্ড বাংলাদেশ প্রধানের ভূমিকা দেশের গার্মেন্টশিল্পের পরিবেশ নষ্ট করতে চায় বলে উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘আমি কারখানায় ঢুকে দেখি প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক ২৫ জন শ্রমিককে ঘিরে রেখেছে। সেখানে রব ওয়েসের সঙ্গে কথা বলে আমার মনে হয়েছে তিনি বিগাফ নামের সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করতে এসেছেন। আমি সেটা অ্যাডিশনাল আইজি মহোদয়কে আমার পর্যবেক্ষণে লিখিত জানিয়েছি। ’
অ্যাকর্ডের ভূমিকা নিয়ে বিজিএমইএ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা যারা কারখানা চালাই তারা দেশের শ্রম আইন মেনে কাজ করি। সমস্যা হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী সমাধান করি। কিন্তু কেউ বাইরে থেকে কাজ বন্ধের হুমকি দিলে সেটা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। ৪৪ জন শ্রমিকের জন্য ১২ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানকে হুমকি দেওয়া উদ্বেগজনক ব্যাপার। বিজিএমইএ সভাপতি দেশের বাইরে আছেন। তিনি ফিরলেই এ বিষয়ে আলোচনা করে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ’