চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে কারখানা করার জন্য জমি বরাদ্দ নিতে পোশাকশিল্প মালিকদের আগ্রহ কম। ৫০০ একর জমির মধ্যে গত দুই মাসে ৪১৯ একর বরাদ্দ পেতে আবেদন করেছে ১৩২ পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। বাকি ৮১ একর জমি বরাদ্দ নিতে কোনো আবেদন পড়েনি। যাঁরা জমি বরাদ্দের জন্য আবেদন করেছেন, তাঁদের মধ্যে ‘বুকিং মানি’ পরিশোধকারীর সংখ্যা খুবই কম।
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে ওষুধ, পোশাক এবং কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ—এই তিন খাতের জন্য আলাদা জমি চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)। এর মধ্যে পোশাক খাতে দেওয়া হবে ৫০০ একর। বেজা গত ১২ অক্টোবর তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সদস্যদের উদ্দেশে চিঠি দিয়ে সাত দিনের মধ্যে প্লট বরাদ্দ পেতে আগ্রহীদের আবেদন করতে বলে। চিঠিতে বলা হয়, প্রতি একর জমির ৫০ বছরের ইজারা মূল্য হবে এক কোটি টাকা। প্লট বুকিং দিতে ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হবে, যা অফেরতযোগ্য। পরের মাসের মাঝামাঝিতে বিজিএমইএ আরেক চিঠিতে সদস্যদের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে প্লটের ১৫ শতাংশ অর্থসহ আবেদন করতে বলে। বাকি ১০ শতাংশ ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে দিতে বলা হয়।
বিজিএমইএর সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ঢাকার ৬৪ ও চট্টগ্রামের ৬৮ পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান কারখানা করার জন্য মিরসরাইয়ে প্লট চেয়ে আবেদন করেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের কাট্টলি টেক্সটাইল সর্বোচ্চ ৫০ একর জমি বরাদ্দ চেয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার ডিবিএল গ্রুপ ২৫ একর, কোরস বাংলাদেশ ২০ একর, চট্টগ্রামের আজিম গ্রুপ ২০ একর, ঢাকার এপিক অ্যাপারেলস ১০ একর, ইউনিগিয়ারস ১০ একর, এসকিউ সেলসিয়াস ১০ একর জমি বরাদ্দ পেতে আবেদন করেছে।
তবে মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্লটের জন্য আবেদন করা ১৩২ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৩৩টি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বুকিং মানি হিসেবে বিজিএমইএ দপ্তরে ২৩ কোটি ৪৫ টাকা জমা দিয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের জমির পরিমাণ ১০২ একর। তার মানে ৩১৭ একর জমির জন্য কোনো অর্থই জমা পড়েনি।
আবেদন করেও প্লট বরাদ্দ নিতে মালিকদের আগ্রহ কম কেন—জানতে চাইলে গতকাল মঙ্গলবার বিজিএমইএর দুজন সহসভাপতি ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দেন।
সহসভাপতি এস এম মান্নান বলেন, ‘অবশ্যই মালিকদের আগ্রহ আছে। তবে হয়তো মুন্সিগঞ্জের বাউশিয়ায় পোশাকশিল্প করার পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় অনেক মালিক একটু ধীরগতিতে এগোচ্ছেন। খোঁজখবর নিচ্ছেন।’ তিনি বলেন, ‘মিরসরাইয়ে গ্যাস-বিদ্যুৎ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। চট্টগ্রাম বন্দর খুব কাছে হবে। জমির দামও তুলনামূলক কম। তাই শেষ পর্যন্ত মালিকদের আগ্রহ না দেখানোর কারণ নেই।’
আরেক সহসভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘প্লটের জন্য ২৫ শতাংশ অর্থ দিতে হবে এবং সেটি অফেরতযোগ্য—এ নিয়েই হয়তো মালিকেরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে আছেন যে প্লট না পেলে টাকাও ফেরত মিলবে না। আসল ঘটনা হচ্ছে, প্লট পেয়েও কেউ যদি নিতে না চান, তাহলেই কেবলমাত্র টাকা ফেরত দেওয়া হবে না। আমরা সবকিছু পরিষ্কার করতে আবেদনকারীদের সঙ্গে বসব।’ তিনি আরও বলেন, অর্থ পরিশোধের জন্য সময় বাড়ানো হবে।
দুই যুগ ধরে পোশাক শিল্পপার্ক স্থাপনের দাবি জানিয়ে আসছে বিজিএমইএ। ২০১৩ সালে পোশাকশিল্প পার্কের জন্য মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ার বাউশিয়া এলাকায় ৫৩১ একর জমি অধিগ্রহণের অনুমতি দিয়েছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। সেখানে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাসহ মোট ৫৭৭টি প্লটের পরিকল্পনা ছিল। তবে প্লটের জন্য আবেদন করেছিল ৪৫০ প্রতিষ্ঠান। পরে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রকল্পটি ভেস্তে যায়।
এদিক মিরসরাইয়ে জমি উন্নয়নের পাশাপাশি গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণের কাজ করছে বেজা। সেখানে গ্যাস সরবরাহের জন্য ২৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপলাইন বসাচ্ছে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি। ১৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করবে আরপিসিএল। আরও ৪০০ মেগাওয়াটের জন্য জমি চেয়েছে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
বেজা সূত্র জানিয়েছে, মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কারখানাগুলোয় পানি সরবরাহের জন্য দুই একরের জলাধার তৈরি করা হবে। পাশাপাশি ফেনী নদীর পানি ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে (আইডব্লিউএম) নিয়োগ করার প্রক্রিয়া চলছে। এই অর্থনৈতিক অঞ্চলের জন্য আলাদা একটি বন্দর থাকবে। চার লেনের একটি সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে। এ সড়কের নির্মাণকাজও উদ্বোধন করা হয়েছে।
জানতে চাইলে মাহমুদ হাসান খান বলেন, ‘আমাদের পোশাকশিল্প মূলত ঢাকার আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে। সে জন্য মিরসরাইয়ে চট্টগ্রামের উদ্যোক্তারাই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তবে কম-বেশি যতগুলো প্রতিষ্ঠানই সেখানে যাক না কেন, সেটি অবশ্যই বিরাট কাজ হবে।’