দেশের পোশাক খাতের তদারককারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে অধিদপ্তরে রূপান্তর হলো বস্ত্র পরিদপ্তর। বস্ত্র শিল্পের উন্নয়ন, সম্প্রসারণ ও বিকাশের লক্ষ্যে পরিদপ্তরটিকে অধিদপ্তরে রূপান্তর করেছে সরকার। এ অধিদপ্তরের তদারকিতে থাকবে তৈরি পোশাক খাতও। যদিও এতদিন ধরে শুধু কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) খাতটিতে নজরদারি কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।
দেশের বস্ত্র খাতের জন্য একক কর্তৃপক্ষের দাবি অনেক আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বস্ত্র পরিদপ্তরকে খাতটির কর্তৃত্ব দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ শাখা, অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন অনুবিভাগ ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের প্রশাসনিক উন্নয়ন ও সমন্বয় অধিশাখার অনুমোদনক্রমে গতকালই অধিদপ্তরে উন্নীত হয় বস্ত্র পরিদপ্তর।
জানা গেছে, পোষক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বস্ত্র পরিদপ্তর এতদিন যে ভূমিকা পালন করে আসছিল, নতুন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে এখন তা আরো জোরদার হবে। ক্ষমতা ও জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের বস্ত্র খাতে পরিদর্শন কার্যক্রম আরো জোরদার করতে যাচ্ছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে মহাপরিচালকের একটি ও পরিচালকের তিনটিসহ মোট ৮৩টি নতুন পদের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বাইরে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে বস্ত্র অধিদপ্তরের নতুন শাখা অফিস খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বিকেন্দ্রীকরণের এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে বস্ত্র অধিদপ্তরের কাজে গতি আসবে বলে মনে করছে বস্ত্র মন্ত্রণালয়।
বস্ত্র খাতের পোষক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এটিকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের আগেই সংশ্লিষ্ট আইনের ‘পোষক কর্তৃপক্ষসংক্রান্ত ভূমিকায়’ পরিবর্তন আনে সরকার। আইন অনুযায়ী, পোষক কর্তৃপক্ষের নিবন্ধন ছাড়া কোনো বস্ত্র শিল্প-কারখানা পরিচালনা করা যাবে না। এছাড়া আরো বেশকিছু শর্ত লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে কারখানার নিবন্ধন বাতিল ও স্থগিত করার ক্ষমতা দেয়া হয় সংস্থাটিকে। নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিতের কারণে কারখানাগুলোর কোনো ক্ষতিপূরণ দাবিরও সুযোগ রাখা হয়নি আইনে।
একই সঙ্গে পোষক প্রতিষ্ঠানের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কারখানা পরিদর্শনে কোনো ধরনের সহযোগিতা করা না হলে তা অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে বলে আইনে বিধান রাখা হয়েছে। এর বাইরেও পোষক কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা বাড়িয়ে আরো কিছু বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে সদ্য গঠিত বস্ত্র অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ইসমাইল বণিক বার্তাকে বলেন, বস্ত্র শিল্পকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য হলো এ শিল্পের আরো বিকাশ ঘটানো। বেসরকারি খাত নিজ থেকেই বর্তমান পর্যায়ে বিকশিত হয়েছে। এখন এ বিকাশ যাতে আরো সুষম ও সুষ্ঠু হয়, সে বিষয়ে ভূমিকা পালন করবে পোষক কর্তৃপক্ষ। ঠিক নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির দৃষ্টিভঙ্গিতে আমরা কাজ করতে চাই না। পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের মাধ্যমে কার্যক্রমটি আরো গতিশীল হবে।
পোশাক খাতের সংযোগ শিল্প হিসেবে আশির দশকে দেশে গড়ে উঠতে থাকে রফতানিমুখী বস্ত্র কারখানা। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে উঠেছে হোম টেক্সটাইল ও টেরিটাওয়েল পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পও। সরকারি কোনো আইন ছাড়াই গত ৩০ বছরে এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানের বিকাশ ঘটেছে। শিল্প নিয়ন্ত্রণে এতদিন পর্যন্ত কোনো নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষও তৈরি হয়নি। তবে এখন নতুন বস্ত্র আইন অনুমোদন ও পোষক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বস্ত্র পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে আসতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট খাতের নয় হাজারের বেশি কারখানা। এসব কারখানা মোট সাতটি সংগঠনের সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে। সংগঠনগুলো হলো— বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ, বিটিটিএলএমইএ, বিএলএমইএ, বিজিএপিএমইএ ও বিএসটিএমপিআইএ। এসব সংগঠন এরই মধ্যে আইনি কাঠামোয় চলে এসেছে। এখন বস্ত্র পরিদপ্তরকে অধিদপ্তরে রূপান্তরের মাধ্যমে শিল্পটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে সরকার।
এ বিষয়ে পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, নতুন কোনো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শিল্পকে সহযোগিতা করা হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কোনো ধরনের হয়রানি আমরা চাই না। এমনিতেই আমাদের অনেক কর্তৃপক্ষের কাছে যেতে হয়। পোশাক খাত একটি মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এমন সময় নতুন কোনো বিড়ম্বনা আমরা চাই না।
এতদিন পরিকল্পনার অভাবে অনেকটা স্বতন্ত্র ধারায়ই এগিয়েছে তৈরি পোশাক খাতটি। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সুনির্দিষ্ট পোষক কর্তৃপক্ষের অনুপস্থিতিতে কখনো বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কখনো বস্ত্র, কখনো শিল্প আবার কখনো বা শ্রম মন্ত্রণালয় খাতটির ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়েছে। কিন্তু কোনো দুর্ঘটনা বা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কেউই এর দায় বহন করতে চাইত না। বিশেষ করে রানা প্লাজা ধস-পরবর্তীতে শিল্পটিতে নির্দিষ্ট অভিভাবকের অভাব সবচেয়ে বেশি প্রকট হয়ে ওঠে।
এ প্রসঙ্গে বিকেএমইএর প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এ কথা সবাই স্বীকার করেন যে, জাতীয় অর্থনীতিতে আমরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছি। কিন্তু এত বড় সেক্টরে আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রক নেই, অভিভাবকও নেই। দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে একটি কর্তৃপক্ষের দাবিতে আমরা বিভিন্ন সরকারের কাছে ধরনা দিয়ে এসেছি। কিন্তু আশ্বাস ছাড়া কিছুই মেলেনি।
তিনি আরো বলেন, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো যার হাতে যেটুকু কর্তৃত্ব আছে, সেটুকু ছাড়তে চায় না বলে পোশাক শিল্পের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় হচ্ছে না। পোষক কর্তৃপক্ষ হিসেবে বস্ত্র অধিদপ্তরের মাধ্যমে এখন একক কর্তৃত্ব পেতে যাচ্ছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। ওয়ান স্টপ সেবা নিশ্চিত করতে পারলেই এ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।