Home Bangla Recent ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানাই বন্ধ

ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানাই বন্ধ

কার্যাদেশের অভাব, লোকসান

পোশাক খাত মূল্যায়নে জাতীয় উদ্যোগের আওতায় থাকা একটি কারখানা ঢাকার রামপুরার রূপা সোয়েটার্স (বিডি) লিমিটেড। প্রাথমিক পরিদর্শনে কারখানাটির ত্রুটি শনাক্ত হয়। কারখানাটি সংস্কারে ব্যয়ের আকার অনেক বেশি হওয়ায় বিদ্যমান স্থানে এটি সচল রাখতে অপারগতা প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। এ প্রেক্ষাপটে কারখানাটি এখন বন্ধ।

একইভাবে বন্ধ রয়েছে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার এমআর সোয়েটার কম্পোজিট গ্রুপের কারখানা। যোগাযোগ করা হলে গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক খন্দকার মবিনুল ইসলাম বলেন, ২০১৫ সালে আমরা সুইং ইউনিট বন্ধ করে দিই। এ পদক্ষেপের মূল কারণ পর্যাপ্ত কার্যাদেশের ঘাটতি। এছাড়া ব্যাংকের দেনার বিষয়টিও কাজ করেছে। কার্যাদেশের অভাবে লোকসানে কারখানা চালু রেখে দেনা বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। ফলে ইউনিটটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

সত্তরের দশকের শেষভাগে শ্রমঘন শিল্প হিসেবে দেশে পোশাক খাতের গোড়াপত্তন হয়। গড়ে উঠতে থাকে একের পর এক কারখানা। তবে এসব কারখানা গড়ে ওঠে মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামকে ঘিরে। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ শিল্পে ২০১২ ও ২০১৩ সালে নেমে আসে তাজরীন ও রানা প্লাজায় দুর্ঘটনার মতো বিপর্যয়। এরপর খাতটির সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে শুরু হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগে মূল্যায়ন কর্মসূচি। জাতীয় উদ্যোগে কর্মসূচির হালনাগাদ তথ্য বলছে, ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ পোশাক কারখানাই এখন বন্ধ।

জাতীয় উদ্যোগে পোশাক শিল্প মূল্যায়ন কার্যক্রমের আওতায় রয়েছে প্রায় দেড় হাজার কারখানা। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের সব জেলায় এসব কারখানার বিভিন্ন ত্রুটি এরই মধ্যে শনাক্ত হয়েছে। প্রাথমিক পরিদর্শনের পর ঝুঁকির মাত্রাভেদে ১ হাজার ৫৪৯টি কারখানাকে গ্রিন, ইয়েলো, অ্যাম্বার ও রেড শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। গ্রিন শ্রেণীভুক্ত কারখানাগুলো নিরাপদ আর রেড শ্রেণীর কারখানাগুলো অতি ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গত চার বছরে রেড শ্রেণীভুক্ত মোট ৫১৩টি কারখানা বন্ধ হয়েছে।

সূত্রমতে, জাতীয় উদ্যোগের আওতায় ১ হাজার ৫৯৪টি কারখানার মধ্যে ঢাকা বিভাগের মোট কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৩১৯। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৬৪৯টি, নারায়ণগঞ্জে ৩৯৮ ও গাজীপুরে ৩৭২টি। এদিকে চার বছরে বন্ধ ৫১৩টি কারখানার মধ্যে ঢাকার ২৭৬, নারায়ণগঞ্জের ২৯৮ ও গাজীপুরের কারখানা ৮৮টি। এ হিসাবে বন্ধ কারখানার ৪৫৫টিই ঢাকা বিভাগের। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকা অঞ্চলের ৩৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ বা এক-তৃতীয়াংশ কারখানাই বন্ধ হয়েছে গত চার বছরে।

জাতীয় উদ্যোগের আওতায় কারখানার প্রাথমিক পরিদর্শন ও পরবর্তী সংস্কার কার্যক্রম কর্মসূচি নিয়ে এগোচ্ছে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিদর্শক সামছুজ্জামান ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, মোট ৫১৩টি কারখানার কয়েকটি আমাদের নির্দেশনায় বন্ধ হয়েছে। অনেক কারখানাই শিল্প বিপর্যয়-পরবর্তী প্রেক্ষাপটের প্রভাবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বন্ধ হয়েছে। এখন আমাদের উদ্বেগ সেসব কারখানা নিয়ে, যেগুলো ত্রুটি নিয়ে সচল আছে, কিন্তু সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করছে না। যথাযথভাবে সংস্কার সম্পন্ন না করলে এমন প্রায় ৮০০ কারখানা আইন অনুযায়ী বন্ধের ব্যবস্থা নেয়া হবে।

অনুসন্ধানে কারখানাগুলো বন্ধ হওয়ার পেছনে বেশকিছু কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। মোটা দাগে তাজরীন ও রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর কারখানার সার্বিক মান বা কমপ্লায়েন্স নিয়ে ক্রেতাদের সতর্কতাই ছিল কারখানা বন্ধের মূল কারণ। ওই দুই ঘটনার প্রভাবে কারখানাগুলোর কার্যাদেশ কমে যায়। কার্যাদেশের অভাবে অনেক কারখানাকেই লোকসানের মুখে পড়তে হয়। তাই কারখানা বন্ধের সুনির্দিষ্ট কারণগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়, বেশির ভাগই বন্ধ হয়েছে কার্যাদেশ না থাকার পাশাপাশি লোকসানের কারণে। এছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কারণের মধ্যে রয়েছে আর্থিক অসচ্ছলতা, ব্যাংকের কাছে দেনা, কর্মপরিবেশ স্বাস্থ্যসম্মত না হওয়া, গ্যাস সংকট, অগ্নিকাণ্ড, কর্তৃপক্ষের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাব, কারখানার জমির মালিককে ভাড়া না দেয়া, পুরনো মেশিন ও শ্রমিক অসন্তোষ।

শিল্পসংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি তথ্য বিশ্লেষণে আরো দেখা যায়, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্র, মাঝারি, বড়— সব ধরনের কারখানাই রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি অনেক কারখানা রয়েছে, যারা কাজ করত সাব-কন্ট্রাক্ট পদ্ধতিতে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি আবার বিজিএমইএ বা অন্য কোনো সংগঠনের সদস্য নয়। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর কারখানা মূল্যায়ন শুরু হলে সাব-কন্ট্রাক্টে চলা অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে পড়ে।

জানতে চাইলে পোশাক খাতের মালিক প্রতিনিধিদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, পোশাক শিল্প মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। জাতীয় উদ্যোগের আওতায় থাকা যেসব কারখানা বন্ধ হয়েছে, সেগুলো পোশাক খাতের রফতানিতে তেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। কারণ এসব কারখানার অনেকগুলোই ক্ষুদ্র ও মাঝারি। বেশির ভাগই পুরনো কারখানা। এগুলো রিমেডিয়েশন বা রিলোকেশন করা সম্ভব হয়নি। এ ধরনের প্রতি ১০টি কারখানা বন্ধ হয়ে সমন্বিত উত্পাদন সামর্থ্যের একটি কারখানা অন্যত্র গড়ে উঠেছে। তাই এ বন্ধের প্রভাব গোটা পোশাক খাতে দেখা যায়নি।

বাংলাদেশ জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, তাজরীন ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরবর্তী প্রেক্ষাপটে পোশাক শিল্পের কারখানাগুলোয় কর্মসংস্থান সংকটের মুখোমুখি হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এসব শ্রমিকের মধ্যে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। অনেকে কাজ নিয়েছেন একই বা অন্য শিল্প কারখানায়। অনেকে পেশাও পরিবর্তন করেছেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here