আশির দশকে প্রায় শূন্য থেকেই শুরু। যত্ন, শ্রম ও দক্ষতা দিয়ে পরে মহীরুহে রূপ দিয়েছেন উদ্যোক্তারা। তাদের হাতে গড়া এ বস্ত্র ও পোশাক শিল্পই এখন দেশের প্রধান রফতানি খাত। যদিও এ উদ্যোক্তাদেরই অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়েছেন। কেউ আবার ব্যবসায় টিকতে না পেরে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়েছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত গত বুধবার জাতীয় সংসদে প্রায় দুই হাজার ঋণখেলাপির যে তালিকা প্রকাশ করেছেন, তাতে এগিয়ে আছেন এ দুই খাতের ব্যবসায়ীরা। তালিকা বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১০ কোটি টাকার ওপর ব্যাংকঋণ নিয়ে আর ফেরত দেননি এমন প্রায় দুই হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৬০০-এর মতো বস্ত্র ও পোশাক খাতের।
এ দুই খাতের মালিক প্রতিনিধিরা বলছেন, দেশে শিল্প-কারখানার বেশির ভাগই বস্ত্র ও পোশাক খাতের। তাই খেলাপি গ্রাহকের সংখ্যা এ খাতে বেশি হবে, এটাই স্বাভাবিক। তালিকায় কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো নামসর্বস্ব। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ঋণখেলাপি হওয়ার দায় পুরো খাতের নয়।
যদিও সংসদে প্রকাশিত তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বড় অংকের খেলাপি ঋণ রয়েছে, এমন শীর্ষ ১০০ গ্রাহকের মধ্যেও বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদেরই আধিক্য। ঋণখেলাপি শীর্ষ ১০০ গ্রাহকের মধ্যে প্রায় ৪৪ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানই এ খাতের। আর প্রথম ৫০০ ঋণখেলাপি বিবেচনায় নিলে এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতের গ্রাহক সংখ্যা ১৫৭। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ম্যাক্স স্পিনিং মিলস, বেনেটেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, আনোয়ারা স্পিনিং মিলস, চৌধুরী নিটওয়্যারস লিমিটেড, হলমার্ক ফ্যাশন লিমিটেড, মুন্নু ফ্যাব্রিকস, ফেয়ার ট্রেড ফ্যাব্রিকস লিমিটেড, সাহারিশ কম্পোজিট টাওয়েল ও কেয়া ইয়ার্ন মিলস লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণতথ্য ব্যুরোর (সিআইবি) ডাটাবেজে রক্ষিত ২০১৭ সালের এপ্রিলভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে ওই বছরের জুলাইয়ে শীর্ষ ১০০ ঋণখেলাপির আরো একাটি তালিকা সংসদে প্রকাশ করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। আর বুধবার প্রকাশ করেছেন গত বছরের নভেম্বরভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে ১ হাজার ৯৫৬ ঋণখেলাপির তালিকা। এদের প্রত্যেকের ঋণই ১০ কোটি টাকার ওপরে। গত ১০ বছরে এসব গ্রাহকের কাছে খেলাপি ঋণ তৈরি হয়েছে ৬৫ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। এ খেলাপি গ্রাহকদের ৩০ শতাংশের বেশি বস্ত্র ও পোশাক খাতের।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণখেলাপির তালিকাটি খতিয়ে দেখা হয়নি। সংগঠনের সক্রিয় সদস্যদের কত সংখ্যক তালিকায় আছে, তা নিয়ে এখনই মন্তব্য করতে পারছি না।
অর্থমন্ত্রীর তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায়, তালিকাটির প্রথম ৫০০ ঋণখেলাপির মতোই পরের ৫০০ খেলাপির মধ্যেও বস্ত্র ও পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে এগিয়ে। তালিকায় ৫০১ থেকে এক হাজার পর্যন্ত ঋণখেলাপির যে নাম এসেছে তাতে ১৪৩টিই এ খাতের। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে আছে সান বিম টেক্সটাইল মিলস লিমিডেট, তিশাম অ্যাপারেলস, গ্র্যান্ড সোয়েটার্স, আলবি টেক্সটাইল মিলস, প্রীতি অ্যাপারেলস, আবদুল্লাহ ডায়িং ইন্ডাস্ট্রি, জেসি হোসিয়ারি গার্মেন্টস (পিভিটি), আরএল ইয়ার্ন ডায়িং, ক্যামিও ইউএসএ নিটওয়্যার ও অ্যাওয়ার্ড নিট গার্মেন্টস লিমিটেড।
সংসদে প্রকাশিত তালিকায় এক হাজার এক থেকে এক হাজার ৫০০ পর্যন্ত ঋণখেলাপির তালিকায়ও বস্ত্র ও পোশাক খাতের উদ্যোক্তার সংখ্যা বেশি— ১৩১টি। এর মধ্যে রয়েছে সুবর্ণ বাংলাদেশ, সিলভার স্টাইল ডিজাইন, রিজি স্টাইল, এমারেল্ড ড্রেসেস, ইউনিটেক্স নিটওয়্যার, এপিটি ফ্যাশন ওয়্যারস, সাংহাই অ্যাপারেলস, বেঙ্গল সোয়েটার ফ্যাশন, ফেম টেক্সটাইল মিলস ও জাগরণ টেক্সটাইল মিল।
এদের সবাই যে অসৎ উদ্দেশ্য থেকে ঋণখেলাপি হয়েছেন, এমনটা মনে করেন না অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, অসৎ উদ্দেশ্যের ব্যবসায়ী নেই সেটা বলা যাবে না। তবে খেলাপিদের বড় অংশ এ শ্রেণীর নয়। বরং বড় অংশটি ব্যবসার ওঠা-নামার কারণেই খেলাপি হয়ে পড়ছেন। পোশাক খাতের ক্ষেত্রে একবার বড় ধরনের ধাক্কা খেলে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে।
তালিকার শেষ ৪৫৬ ঋণখেলাপির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এর মধ্যে বস্ত্র ও পোশাক খাতের প্রতিষ্ঠান রয়েছে ১৫৭টি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হলো— ঝিনাই টেক্স, ওয়েস্টার্ন ফ্যাব্রিকস, গোমতী টেক্সটাইল, ইসলাম অ্যাটায়ার্স, নর্থবেঙ্গল টেক্সটাইলস, উডল্যান্ড অ্যাপারেলস, ঊষা সোয়েটার কোম্পানি, লিয়েন টেক্স কম্পোজিট নিট লিমিটেড, হাডসন সোয়েটার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ও ওপেক্স ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
সংসদে প্রকাশিত খেলাপিদের এ তালিকা সম্পূর্ণভাবে খতিয়ে দেখার এখনো সুযোগ হয়নি বলে জানান বস্ত্র খাতের সংগঠন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, তবে কিছু প্রতিষ্ঠানের নাম জানতে পেরেছি, যেগুলো ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠান। কিছু প্রকৃত খেলাপি প্রতিষ্ঠান থাকতে পারে। খেলাপি হলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সংগঠনের পক্ষে যদি কিছু করার থাকে, তালিকাটি আরো খতিয়ে দেখার পরই সে ব্যাপারে বলা যাবে।