রফতানিমুখী বৃহত্তম খাত গার্মেন্টস শিল্পে শুধুই হতাশা নয়। বরং আছে সুবর্ণ সুযোগ ও সম্ভাবনা। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, বিশ্ববাজারে গার্মেন্টস পণ্য রফতানিতে ৩৯ শতাংশ অর্থাৎ একক বৃহৎ অবদান চীনের। আর বাংলাদেশের অবদান মাত্র ৬ শতাংশ। উচ্চমূল্যের মজুরিসহ বিভিন্ন কারণে ২০২১ সাল নাগাদ চীনের অবদান নেমে যাবে ২০ শতাংশে। চীনের হারানো অবশিষ্ট ১৯ ভাগ বাজার বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সুযোগ এনে দেবে। তবে সেই সুযোগ আয়ত্ত করতে হলে এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় প্রতিযোগী দেশ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার কাছে গার্মেন্টস খাতের সেই অপার সুযোগ-সম্ভাবনা হাতছাড়া হয়ে যাবে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি, নিয়েলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিঃ এবং অন্যান্য সংস্থার নিবিড় গবেষণা সূত্রে উপরোক্ত আশাবাদ ফুটে উঠেছে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গার্মেন্টস খাতে মূল্য সংযোজন তথা আয় বৃদ্ধি করতে হলে রফতানি পণ্যে যুগোপযোগী বৈচিত্র্যকরণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। কেননা পুরনো গৎবাঁধা উৎপাদিত গার্মেন্টস সামগ্রী আন্তর্জাতিক বাজার প্রসারে আর সহায়ক হবে না।
সিপিডি’র গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালের রানা প্লাজা ধসের প্রেক্ষাপটে গার্মেন্টস খাত সঙ্কট আর সম্ভাবনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্লাজা দুর্ঘটনার পর কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে অ্যাকর্ড ও এলায়েন্সের গৃহীত কড়াকড়ি পদক্ষেপের ফলে এ পর্যন্ত ১২শ’ ৫০টি গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে অ্যাকর্ড-এলায়েন্স-আইএলও, সরকারের কমপ্লায়েন্স ইস্যুতে আরও অন্তত সাড়ে ৭শ’ কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। গার্মেন্টস খাতে এসব চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে অবিলম্বে দিক-নির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে। এরজন্য পূর্বশর্ত হিসেবে নিরবচ্ছিন্ন উৎপাদনশীলতা, কর্ম-পরিবেশ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা বাড়াতে অধিকতর মনোযোগী হতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছরে ৫০ বিলিয়ন ডলার তৈরি পোশাক রফতানির লক্ষ্যমাত্রা পূরণে যেমন পূর্ণ মনোনিবেশ করতে হবে, তেমনি এরমধ্যে যাতে স্থানীয় মূল্য সংযোজন বেশি থাকে সেদিকেও গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিতে হবে। রানা প্লাজা ঘটনার পর বাংলাদেশ গার্মেন্টস খাতে বিরাট ধকল সামাল দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় এখনও নিয়োজিত রয়েছে। গার্মেন্টস খাত এখন বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্টস শিল্প দীর্ঘদিন ধরে একক বৃহৎ শিল্প হিসাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশ্ববাজারে চাহিদার নিরিখে পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। এর পাশাপাশি নতুন বাজারসমূহে কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং বাজার সন্ধান করতে হবে। এক্ষেত্রে বর্তমান শ্রমঘন শিল্প থেকে আধুনিক প্রযুক্তিভিত্তিক উৎপাদন কার্যক্রমে উত্তরণ ঘটাতে হবে এ শিল্পের। তাছাড়া নেপথ্যে অশুভ শক্তি দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে তৎপর রয়েছে। অশুভ শক্তির অপতৎপরতা গার্মেন্টসে অশনি সঙ্কেত হিসেবে মাথায় রেখেই দেশের বৃহত্তম এই রফতানিমুখী খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে ঐক্যবদ্ধভাবে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে।
আমেরিকান একটি খ্যাতনামা গেøাবাল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ‘ম্যাককিনসে অ্যান্ড কোম্পানি’ পরিচালিত জরিপ এবং আন্তর্জাতিক অপর এক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নিয়েলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেডে’র জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে সঙ্কটের তুলনায় সুবর্ণ সুযোগ-সম্ভাবনার দিক ফুটে উঠেছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতির প্রাণশক্তি গার্মেন্টস খাত সঙ্কটের মাঝেও তার দুর্দমনীয় অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে। তবে এরজন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও নির্দেশনা গ্রহণ জরুরি।
সমস্যা-সঙ্কটের তুলনায় দেশের রফতানিমুখী গার্মেন্টস শিল্পখাতে সম্ভাবনাই বেশি। কেননা বৈশ্বিক বাজার পরিস্থিতি, বাংলাদেশের নি¤œতম শ্রম মজুরিহার, সঙ্কট উৎরে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রচেষ্টাসহ বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার ফলে এ খাতে রফতানি আয় আগামী ৫ বছরে দ্বিগুণ এবং ১০ বছরে তিনগুণ উন্নীত হওয়ার অবারিত সুযোগ রয়েছে। গার্মেন্টস খাতে রফতানি আয় আগামী ১০ বছরে ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হতে পারে। ম্যাককিনসে জরিপে চীনের পর বিশ্বে বাংলাদেশকেই তৈরি পোশাক রফতানিকারক উপযুক্ত দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বায়ারদের (ক্রেতা দেশসমূহ) আমদানি উৎসের সোপান এখন চীনমুখী না হয়ে বাংলাদেশ অভিমুখী হচ্ছে। ইউরোপ-আমেরিকার বড় বায়াররা বাংলাদেশকেই পোশাক সোর্সিংয়ে সর্বোত্তম ঠিকানা হিসেবে বিবেচনা করছে। ম্যাককিনসে জরিপে বলা হয়, চীন বিভিন্ন কারণে বিদেশি ক্রেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারাচ্ছে। বাংলাদেশে ইতিমধ্যে প্রায় ৫ হাজার গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কর্মরত ৩৬ লাখ পোশাক কর্মী বা শ্রমিক। এর বিপরীতে পোশাকশিল্পের অন্যতম দেশ ইন্দোনেশিয়ায় রয়েছে ২ হাজার ৪৫০টি কারখানা, ভিয়েতনামে ২ হাজার এবং কম্বোডিয়ায় ২৬০টি কারখানা। বাংলাদেশে উৎপাদিত তৈরি পোশাকের দর অনেক প্রতিযোগিতামূলক এবং সহজলভ্য।
গার্মেন্টস খাতের বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নেইলসেন কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিঃ’ বলছে, এ শিল্পখাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের ৪ কোটিরও বেশি লোক নির্ভরশীল। ব্যাংক ও বীমা খাতে এ শিল্প জোগান দিচ্ছে ১ হাজার ৯০ কোটি টাকা এবং ১৭০ কোটি টাকা। শিপিং খাতে অবদান ১ হাজার ৯৬০ কোটি টাকা। পরিবহন খাতে অবদান ৮৩০ কোটি টাকা। এ খাত থেকে স্ট্যাম্প, লাইসেন্স নবায়ন ফি প্রভৃতি বাবদ সরকারের আয়ের অংক ১৮০ কোটি টাকা। এ শিল্পের প্রত্যক্ষ কর হিসেবে সরকার ৫৫২ কোটি টাকা আয় করেছে। সেবাখাতে গার্মেন্টসের অবদান ১১০ কোটি টাকা, প্রকৌশল খাতে ৪৩১ কোটি টাকা, বিদ্যুৎ বিল বাবদ ৪৪১ কোটি টাকা, গ্যাস ও ওয়াসা খাতে ১১১ কোটি টাকা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ২৯৬ কোটি টাকা, আবাসন খাতে ৭৮৫ কোটি টাকা এবং হোটেলস ও পর্যটন খাতে ১৩৯ কোটি টাকা। এরফলে সমগ্র গার্মেন্টস শিল্প জাতীয় অর্থনীতির প্রাণস্বরূপ।
ম্যাককিনস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেতারা (বায়ার) এখন বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক বেশি ফ্যাশন্যবল বা বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং জমকালো ধরনের পোশাকজাত পণ্য কিনতে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে পারদর্শী ও সক্ষম হতে হলে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের দক্ষতা আরও গতিশীল করতে হবে। শ্রমিক ও কর্মীদের দক্ষতা, সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়টিও নিশ্চিত থাকা চাই। কারখানাগুলোর উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশ যদি তার পোশাক শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধির সুবর্ণ সুযোগ-সম্ভাবনাকে ২০২০ সাল নাগাদ ৩ গুণ করতে চায় তাহলে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের গড় উৎপাদনশীলতা ভারতের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। ভারতের পোশাক কারখানার উৎপাদনশীলতা (প্রোডাক্টিভিটি) ৯২ পয়েন্ট। সেখানে বাংলাদেশের মাত্র ৭৭।
গার্মেন্টস খাতের প্রধান অপরিহার্য অবকাঠামো হিসেবে বিবেচিত কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে উপরোক্ত জরিপ প্রতিবেদন ও সুপারিশে বলা হয়, কমপ্লায়েন্সই হচ্ছে এখন ব্যবসায়িক সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি। গ্রোথ পটেনশিয়াল বা প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাগুলো ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের তাদের দক্ষতার মান বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন মেশিনারিজ স্থাপনে বিনিয়োগের অভাব, প্রযুক্তিগত সুবিধার অভাব এবং সর্বোপরি দক্ষ শ্রমিকের অভাব বাংলাদেশের উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন ব্যাহত করছে। নজরকাড়া, নামিদামি পণ্য উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যেতে এসব অন্যতম বাধা। গার্মেন্টস খাতে ২০২০ সালের মধ্যে আয় তিনগুণ উন্নীত করতে হলে এরজন্য প্রয়োজন আরও ৩৫ লাখ বেশি সংখ্যক শ্রমিক এবং মাঝারি সারির ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মানব সম্পদ। অথচ এ শিল্পে এখন পর্যাপ্ত দক্ষ মানব সম্পদের মারাত্মক ঘাটতি রয়েছে। স্থানীয় মেধার অভাবে কারখানাগুলোকে বিদেশ থেকে মিডল ম্যানেজম্যান্ট আমদানি করতে হচ্ছে। সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে এই বিদেশি মিডল ম্যানেজম্যান্ট বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যার উদ্ভব ঘটাচ্ছে। দেশে টেকনিক্যাল স্কিলের জন্য বিদ্যামান ইনস্টিটিউটের সংখ্যা খুবই অপ্রতুল। শ্রমিকরা স্বল্প শিক্ষিত হওয়ার কারণে দেশের পোশাক কারখানাগুলোর দক্ষতার হার অনেক কম।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, দেশে গার্মেন্টস কারখানাগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও ঢাকার আশপাশে অবস্থিত। শ্রমিক স্বল্পতা নিরসনকল্পে এ শিল্পের ভৌগোলিক বিস্তার প্রয়োজন। কারখানাগুলোতে বিরাজমান শ্রমিক সঙ্কট নিরসন এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও বিশেষ করে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে পোশাক কারখানা স্থাপন ও অবকাঠামোগত সুবিধা গড়ে তোলা প্রয়োজন। সেই সাথে চট্টগ্রাম বন্দর, মহাসড়ক সুবিধার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ, পণ্য পরিবহন দ্রতায়িত করা এবং লিড টাইম নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।