বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়ার পূর্বাভাস দিলেও বাংলাদেশের পূর্বাভাস আগের মতোই রেখেছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল প্রকাশিত হালনাগাদ বিশ্ব অর্থনীতির পূর্বাভাস প্রতিবেদনে সংস্থাটি উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশে চলতি অর্থবছরে মোট দেশজ উত্পাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৪ ভাগ হতে পারে। সাম্প্রতিককালের বন্যা, আর্থিক খাতে সংস্কার পদ্ধতিতে দুর্বলতা, রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচনসহ বিভিন্ন কারণে সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী ৭ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধির চেয়ে কম প্রাক্কলন করলো বিশ্বব্যাংক। এর আগে গেলো বছর সেপ্টেম্বর মাসে দেওয়া হালনাগাদ পূর্বাভাস প্রতিবেদনেও ৬ দশমিক ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছিলো সংস্থাটি। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন ইত্তেফাককে বলেন, বিশ্বে ১৩৪টি দেশের মধ্যে মাত্র ১৭টি দেশ এবছর ৬ দশমিক ৪ ভাগ বা তার বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সে হিসাবে ৬ দশমিক ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কম নয়। তবে সরকারের ৭ দশমিক ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সেটি অর্জন অসম্ভব নয়, তবে চ্যালেঞ্জিং বলে মনে করেন তিনি। এর কারণ ব্যাখা করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে যে ভঙ্গুরতা রয়েছে সেটি দারিদ্র্য হ্রাস ও বিনিয়োগের জন্য পুরোপুরি সহায়ক নয়। অবকাঠামো খাতে বড় প্রকল্পের গতিও মন্থর। এবছর বড় কোন প্রকল্প শেষ করার আশা নেই। তাছাড়া দেশের অর্থনীতিতে এখনও অনেক সংস্কার করা প্রয়োজন। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণেরও সম্ভাবনা কম। সেইসাথে নির্বাচনকে ঘিরে একটি শঙ্কা থেকেই যায়। তাই অর্থনীতি যে গতিতে এগুচ্ছে তাতে ৬ দশমিক ৪ ভাগের মতো প্রবৃদ্ধি হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৭ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৮ সালে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির আকার বেড়ে ৩ দশমিক ১ শতাংশ হতে পারে, যা আগের বছর ৩ শতাংশ হয়েছিলো। তবে ভবিষ্যতে এ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়া, শিল্প উত্পাদন এবং বাণিজ্য পরিস্থিতির উন্নতি, নিত্যপণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পাওয়াসহ মন্দার প্রভাব কাটতে শুরু করায় প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন কিছুটা বাড়ালো বিশ্বব্যাংক। তবে বিশ্বে জীবনযাত্রার মান উন্নত করা এবং ভবিষ্যতে দারিদ্র্য হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক আশা করছে উন্নত বিশ্বের অর্থনীতিতে এবছর প্রবৃদ্ধি হতে পারে ২ দশমিক ২ ভাগ। উদীয়মান ও উন্নয়নশীল বিশ্বে এবছর সাড়ে ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধি হতে পারে। প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম উল্লেখ করেছেন, মানব সম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করার এটাই বড় সুযোগ। যদি বিশ্বের নীতি নির্ধারকরা এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় সেক্ষেত্রে তাদের দেশের উত্পাদনশীলতা বাড়বে, কর্মসংস্থানও বাড়বে। একইসাথে দারিদ্র্য বিমোচনে তাদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবে।
এবারের প্রতিবেদনে ২০১৪-২০১৬ সময়কালে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের মূল্যের পতন, বিশ্বের সম্পদ ব্যবস্থাপনার অসমতাসহ আগের অভিজ্ঞতাগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদেন পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য এবছর প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়ে ৬ দশমিক ২ করা হয়েছে যা আগের প্রতিবেদনে ৬ দশমিক ৪ ভাগ ছিলো। চীনে গেলো বছর ৬ দশমিক ৪ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন হয়েছে যা এবছর ৬ দশমিক ৮ হবে বলে পূর্বাভাস করা হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বাড়িয়ে ৫ দশমিক ৩ করা হয়েছে। রাশিয়ার প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস ১ দশমিক ৭ এ অপরিবর্তীত রয়েছে। তুরস্কে গেলো বছর ৬ দশমিক ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি থেকে এবছর পূর্বাভাস সাড়ে তিন ভাগে নামিয়ে আনা হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে এবছর প্রবৃদ্ধি ১ দশমিক ৮ থেকে বাড়িয়ে ৩ ভাগ করা হয়েছে।
আর্থিক খাতের সংস্কারে নেওয়া বিভিন্ন কর্মসূচির ফলে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সৌদি আরবে গেলো বছর শূন্য দশমিক ৩ ভাগ প্রবৃদ্ধি হতে এবছর ১ দশমিক ২ ভাগ প্রবৃদ্ধির আশা করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার গেলো বছর সাড়ে ৬ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে এবছর এটি বৃদ্ধি পেয়ে ৬ দশমিক ৯ ভাগ হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ ভোগ বৃদ্ধি পাওয়াসহ বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নের ফলে ভারতের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৩ ভাগ পর্যন্ত হতে পারে, যা গেলো বছর হয়েছিলো ৬ দশমিক ৭ ভাগ। পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি গেলো বছর সাড়ে ৫ ভাগ থেকে এবছর ৫ দশমিক ৮ ভাগে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।