রফতানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিশ্চিত করতে ২৭টি আন্তর্জাতিক শর্ত পূরণের পথে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া শ্রম অধিকার, পরিবেশগত সুরক্ষা ও সুশাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে বিনিয়োগ পরিবেশ, অবকাঠামো উন্নয়ন, নিরাপদ কর্ম পরিবেশ এবং শ্রমিকদের মজুরিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। এ কারণে এলডিসি (স্বল্পন্নোত দেশ) তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর জিএসপি প্লাস সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে ভারত, পাকিস্তানসহ ২৫ দেশ বর্তমান বিশ্বে এ সুবিধা পেয়ে আসছে। মানবাধিকার, শ্রম অধিকারসহ অর্থনৈতিক প্রতিটি সূচকে এখন পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এ তথ্য।
সূত্রমতে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আগামী ২০২৩ সালে নতুন জিএসপি পলিসি করতে যাচ্ছে। সেই সময় জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে আগ্রহী দেশকে অবশ্যই মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারবিষয়ক ২৭টি আন্তর্জাতিক সনদ এবং পরিবেশগত সুরক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২৫টি শর্ত পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। ইইউ রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি জানিয়েছেন, এই ২৭টি সনদের বেশির ভাগ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বাক্ষর ও অনুমোদন করেছে। বাংলাদেশ সঠিক পথেই আছে।
এদিকে, আগামী তিন বছরের মধ্যে এলডিসি থেকে বেরিয়ে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাচ্ছে বাংলাদেশ। এর ফলে রফতানি খাতে এখন যে পদ্ধতিতে জিএসপি (জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রিফারেন্সেস) সুবিধা পাওয়া যায়, ভবিষ্যতে এটি আর থাকছে না। রফতানিতে টিকে থাকতে হলে জিএসপি প্লাস সুবিধা নিতে হবে বাংলাদেশকে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে এখন সেই সুবিধা নিশ্চিত করতে কাজ করা হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তিনটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিএফটিআই (ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউট) এ বিষয়ে একটি ধারণাপত্র তৈরি করেছে। আগামী মার্চ মাসে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেতে জাতিসংঘ আবেদন করবে বাংলাদেশ। এই স্বীকৃতি অর্জনে যে তিনটি সূচক বিবেচনায় নেয়া হয় তা অর্জনে যথেষ্ট এগিয়েছে বাংলাদেশ। এগুলো হচ্ছে- মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদের অবস্থান এবং অর্থনীতির ঝুঁকিগ্রস্ততা। ইতোমধ্যে অর্থনীতির ঝুঁকিগ্রস্ততা সূচকে বাংলাদেশ নির্ধারিত মাপকাঠি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। অন্য দুটো সূচকে খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। এ কারণে ২০১৮ সালের মধ্যেই তিনটি সূচকে নির্ধারিত প্রমাপ অর্জন করা সম্ভব হবে।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানান, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ২০২১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে কাতারে শামিল হবে। এ বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এই স্বীকৃতি আসবে জাতিসংঘ থেকে। এ লক্ষ্যে আগামী ২০১৮ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের কাছে সরকার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব প্রেরণ করবে। মাথাপিছু জাতীয় আয়, মানবসম্পদের অবস্থান এবং অর্থনীতির ঝুঁকিগ্রস্ততা বিবেচনায় নিয়ে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি দেয়। অর্থনীতির ঝুঁকিগ্রস্ততা সূচকে দেশ অনেক দূর এগিয়েছে। বাকি দুটোতেও অর্জন কাছাকাছি। এ কারণে ২০১৮ সালে তিনটি সূচকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সময়ে বিশ্বে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পাবে। শুধু তাই নয় স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে আসবে বাংলাদেশ। সরকারের পক্ষ থেকে আরও বলা হয়েছে, স্বপ্নের দ্বিগন্ত আরও প্রসারিত করা হয়েছে। ছয় শতাংশের বৃত্ত ভেঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধির সোপানে আরোহন এবং মাথাপিছু আয়ের ধারাবাহিক উত্তরণ ঘটিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধশালী দেশের কাতারে শামিল হওয়া সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
আর এসব কারণে উন্নত রাষ্ট্রগুলো বলছে, এলডিসি থেকে যেহেতু বাংলাদেশ বেরিয়ে আসছে তাই দেশটিকে শুল্ক ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধা পেতে হলে অবশ্যই জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় আসতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান, ২০২১ সালের আগেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে বাংলাদেশ। সে অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে কাজ শুরু করা হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে যাচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ ইইউ বাজারে জিএসপি প্লাস সুবিধার আওতায় প্রবেশ করতে সমর্থ্য হবে।
ইতোপূর্বে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশকে শ্রমবিষয়ক আন্তর্জাতিক সনদগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ইপিজেড) আইনের খসড়া প্রণয়ন, ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দেয়া এবং শ্রম আইন সংশোধনের আহ্বান জানিয়েছিল। এরপর ইউরোপীয় ইউনিয়নও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয়ায় ইইউতে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা বহাল থাকা নিয়ে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছিল। ইউরোপীয় বাণিজ্য কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, জিএসপি প্লাস সুবিধা পেতে আগ্রহী দেশগুলোকে অবশ্যই মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারবিষয়ক ২৭টি আন্তর্জাতিক সনদ এবং পরিবেশগত সুরক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে হয়। এ প্রসঙ্গে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বাজারসুবিধা নীতির আলোকে বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) ইইউতে পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারমূলক বাজার (জিএসপি) সুবিধা পায়। তবে এই জিএসপিটি হলো অস্ত্র বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা। বর্তমানে শুধু এলডিসিগুলো এ সুবিধা পায়। তবে এলডিসির কাতার থেকে বেরিয়ে গেলে বাংলাদেশ আর এ সুবিধা পাবে না। সে ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য জিএসপি প্লাস হিসেবে পরিচিত যে বাজারসুবিধা আছে, সেটি বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। বাংলাদেশকে দুই ধরনের প্রস্তুতি নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, পোশাক খাতের বাইরে এই সুযোগটা আমরা খুব কমই নিতে পেরেছি। তাই সরবরাহ, রফতানি এবং প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়িয়ে আরও কিভাবে পোশাক খাত এবং এর বাইরে এই সুবিধাটা নিতে পারি সেটা দেখতে হবে।
প্রসঙ্গত, ৪২ বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকায় থাকার পর বাংলাদেশ চলতি বছর উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার স্বীকৃতি পেতে যাচ্ছে। বাংলাদেশের জন্য এই অর্জন অনেক মর্যাদার বলে মনে করা হচ্ছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীলে উত্তরণের জন্য বিবেচ্য তিনটি সূচকেই উত্তীর্ণ হয়ে এ দেশ এ স্বীকৃতি অর্জন করতে চলেছে। ইআরডি সচিব কাজী শফিকুল আযম জনকণ্ঠকে বলেন, এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলেও বাংলাদেশ যাতে রফতানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পায় সেজন্য একটি টাস্ক ফোর্স গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের ফলে সম্ভাব্য প্রতিকূলতা ও উত্তরণের ক্রান্তিকাল যাতে মসৃণ হয় উন্নয়ন পরিকল্পনা, উন্নয়ন কর্মসূচী এবং প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে যাতে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয় এজন্য এখন থেকে কার্যক্ষেত্রে নিবিড় সম্পৃক্ততা বজায় রাখা জরুরী হয়ে পড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি স্ট্যাটাস থেকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।