সরকারি নীতিসুবিধার সর্বোচ্চ ভোগ করে দেশের শ্রমঘন পোশাক খাত। কিন্তু অগ্রাধিকার থাকলেও সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাত সরকারের এ সুবিধাপ্রাপ্তিতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। এমনই একটি খাত দেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালে চামড়া খাত থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও নীতিসুবিধার বৈষম্যে ও বাস্তবায়নযোগ্য নীতির অভাবে এ লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয় রয়েছে। গতকাল চামড়া খাতসংশ্লিষ্টদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক পরার্শক সভায় এমন মত প্রকাশ করা হয়।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘লেদার অ্যান্ড লেদার গুডস এক্সপোর্টস ফ্রম বাংলাদেশ: পারফরম্যান্স, প্রসপেক্টস অ্যান্ড পলিসি প্রায়োরিটিজ’ শীর্ষক পরামর্শক সভার আয়োজন করে বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (বিইআই)। সভায় সভাপতিত্ব করেন বিইআই প্রেসিডেন্ট এবং সিইও সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিইআই প্রজেক্ট লিডার (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট) ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক। আলোচকদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিপার্টমেন্ট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ, এমসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাসিম মঞ্জুর, এলএফএমইএবির সভাপতি ও পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়ফুল ইসলাম এবং ফরচুনা ফুটওয়্যার অ্যান্ড লেদারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফায়াজ তাহের।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনায় ড. মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক বলেন, রফতানি খাতকে বৈচিত্র্যময় করার জন্য সম্ভাবনাময় একটি খাত হলো চামড়া খাত। ২০২১ সালে এ খাত থেকে আয়ের লক্ষ্য ৫ বিলিয়ন ডলার। এ খাতে শক্তিশালী ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প আছে, আছে অব্যবহূত সক্ষমতা, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতাও রাখে এ খাতটি, পাশাপাশি আছে দ্রুত বর্ধনশীল স্থানীয় বাজার।
মূল প্রবন্ধে বলা হয়েছে, প্রতিযোগী দেশগুলো যে হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, সে তুলনায় প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে না চামড়া খাত। এক্ষেত্রে ভিয়েতনাম উল্লেখযোগ্য একটি দেশ। চামড়াপণ্যের বাজার বিবেচনায় নিলেও একই রকম চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। যেমন চীনের চামড়া খাতের বাজারে ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, ভারতের ১ দশমিক ৯২ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের শূন্য দশমিক ৪৭ শতাংশ। একই অবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেও। চামড়া খাতের বিকাশে ব্যবসার ব্যয় কমিয়ে আনা, মুদ্রা বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ, প্রণোদনা, অবকাঠামো উন্নয়ন, সাভার ট্যানারি সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করাসহ বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য ও সমন্বিত নীতিসহায়তার সুপারিশও জানানো হয়। এছাড়া অর্থায়ন নিশ্চিত করা, বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং দক্ষ জনশক্তি উন্নয়নের সুপারিশও করা হয় মূল প্রবন্ধে।
অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ বলেন, রফতানি খাত বৈচিত্র্যময় করার বিষয়ে আমাদের মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। সম্ভাবনা ও প্রতিযোগী সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কেন চামড়া খাতের বিকাশ যথাযথভাবে হচ্ছে না, তাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এমসিসিআই সাবেক সভাপতি ও এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে লিড টাইম নিশ্চিত করা। ইতালি থেকে ফুটওয়্যারের অ্যাকসেসরিজ বা আনুষঙ্গিক পণ্য বাংলাদেশে পৌঁছাতে সময় লাগে ৫৪ দিন। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, বাজারের গতি পণ্যের মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা বাতিল হওয়ায় দেশের ইপিজেড থেকে ভেনচুরা নামের একটি প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ তুলে নেয়ার বিষয়টিও উল্লেখ করেন তিনি। তার সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল সাভার ট্যানারিকে কার্যকর করা, দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়নযোগ্য নীতি, পোশাক খাতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতিসুবিধা, গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনে করপোরেট ট্যাক্স হারে বৈষম্য দূর করা, আমদানি শুল্ক যৌক্তিক করা, কারিগরি বিশেষজ্ঞ সেবার ওপর অতিরিক্ত চার্জ না করা, বিমানবন্দরে পণ্য রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়ন।
এলএফএমইএবির সভাপতি ও পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়ফুল ইসলাম বলেন, অনেক সম্ভাবনা সত্ত্বেও চামড়া খাতের সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। বর্তমানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো আমদানি-রফতানির লিড টাইম নিশ্চিত করা।
বিইআই প্রেসিডেন্ট এবং সিইও সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জিএসপি শুধু পোশাক খাতের জন্য নয়, বরং অন্য খাতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। গ্রিন কারখানা স্থাপনও শুধু পোশাক খাত নয়, বরং অন্য সব খাতের জন্য প্রযোজ্য। সরকারের নীতিনির্ধারণে আজকের আলোচনার প্রেক্ষিতে পাওয়া বিভিন্ন সুপারিশ বিইআইয়ের পক্ষ থেকে জানানো হবে। আমলাতান্ত্রিকতার বিষয়েও কাজ করবে বিইআই। দিন শেষে আমাদের প্রয়োজন হবে খাতের জন্য প্রণয়ন করা নীতির যথাযথ বাস্তবায়ন।