তিন দফা দর কষাকষির পর গত জুনে ১ লাখ পিস শার্টের রফতানি আদেশ পায় সাদমা ফ্যাশনওয়্যার লিমিটেড। শেষ পর্যন্ত দরও খারাপ দাঁড়ায়নি। শার্টপ্রতি ১০ ডলার। মজুদ এবং প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহ করে উৎপাদন চলছে পুরোদমে। তিন সপ্তাহ পর উৎপাদনের শেষ দিকে প্রাইস ট্যাগ (পণ্যের গায়ের দর) কারখানায় নিয়ে আসেন ব্র্যান্ডের দু’জন প্রতিনিধি। ট্যাগের দরে নজর পড়তেই চোখ ছানাবড়া কারখানা ম্যানেজারের। প্রাইস ট্যাগে মূল্য লেখা ১০০ ডলার। অর্থাৎ আমদানিকারক ওই ক্রেতা পোশাকটি বিদেশের বাজারে বিক্রি করবেন ১০০ ডলারে। সাদমা ফ্যাশনের মালিক এবং বিজিএমইএর পরিচালক নাসির উদ্দিন কয়েকবার উল্টে-পাল্টে দেখলেন নিলিশ কার্ড পেপারের ট্যাগটি। না তিনি ভুল দেখেননি। স্পষ্ট ওয়ান জিরো জিরো। সমকালকে এই উদ্যোক্তা বললেন, ‘আমাদের কিচ্ছুই করার নাই। ক্রেতা যে দামের ট্যাগ ঝুলাতে বলবেন, সেটাই ঝুলাতে হবে। তিনি বলেন, কখনও কখনও বিক্রিমূল্য আড়াল করার জন্য গোপন বারকোড ব্যবহার করে ব্র্যান্ডগুলো। ব্যবসায়িক স্বার্থে ওই ব্র্যান্ডের নাম উল্লেখ না করার অনুরোধ করেছেন তিনি।’ এভাবেই বাংলাদেশের পোশাক মালিকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
উৎপাদন ও ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির অস্বাভাবিক এ ব্যবধান কখনও কখনও আরও বড়। উদ্যোক্তাদের মতে, ব্র্যান্ড এবং খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো কৌশল করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। এ কারণে ন্যায্য দর পাচ্ছেন না উৎপাদকরা। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবা সংকট যেমন- লিড টাইম (রফতানি আদেশ থেকে ক্রেতার হাতে পণ্য পৌঁছানোর সময়) বেশি লাগা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা- এসব দুর্বলতা মনে করিয়ে দিয়ে আলোচনা শুরু করেন ক্রেতারা। এ ছাড়া অর্ডার বা কাজ ধরতে উদ্যোক্তাদের মধ্যে এক ধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা আছে। সেই সুযোগও নেন বিদেশি ক্রেতারা।
নাসির উদ্দিন বলেন, ক্রেতারা পোশাকের নমুনা নিয়ে উদ্যোক্তাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে বসেন। এ রকম অনেক উদাহরণ আছে, একজন ক্রেতা প্রতিনিধি এক টেবিলে কয়েকজন উদ্যোক্তাকে নিয়ে আলোচনায় বসেন। অনেকটা নিলামের মতো যে উদ্যোক্তা সর্বনিম্ন দরে কাজ করতে রাজি, তাকেই রফতানি আদেশ দেন ক্রেতা। বিজিএমইএ পরিচালক আ ন ম সাইফুদ্দিন সমকালকে বলেন, সব কারখানার বাস্তবতা এক রকম নয়। বড় কারখানায় এ ধরনের সমস্যা নেই। তবে মাঝারি এবং ছোট-মাঝারি কারখানায় মাঝে মাঝেই কাজ থাকে না। অথচ শ্রমিকদের মজুরি এবং ব্যবস্থাপনার খরচ অব্যাহত থাকে। এ বিবেচনা থেকে ক্ষতি কিছু কমিয়ে আনতে অনেক মালিক এ ধরনের রফতানি আদেশ নিয়ে থাকেন। এ রকম অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণেও দর কম পান উদ্যোক্তারা।
উদ্যোক্তাদের মধ্যে এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে একবার উদ্যোগ নিয়েছিল বিজিএমইএ। নির্দিষ্ট দরের কমে কেউ কাজ নেবেন না- এ রকম আলোচনাও হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তা আর সফল হয়নি। পোশাকের ন্যায্য দর আদায়ে বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও পাকিস্তানকে নিয়ে ‘আঞ্চলিক সহযোগিতা ফোরাম’ নামে একটি ফোরাম গঠন করা হয়। ২০১৬ সালে চীনের সাংহাইয়ে ফোরামের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে উদ্যোগও ভেস্তে যায় বলে সমকালকে জানিয়েছেন ফোরামে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিজিএমইএর সিনিয়র সহসভাপতি ফারুক হাসান।
উৎপাদন এবং বিক্রিমূল্যে বড় ব্যবধানের কারণ কী জানতে চাইলে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা সমকালকে বলেন, পরিবহন ব্যয়, পোশাক মজুদ রাখা, এজেন্টের মাধ্যমে ক্রয়, বিপণন ব্যবস্থাপনায় ব্যয়- সব মিলে একটা বড় অঙ্কের খরচ থাকে ক্রেতাদের। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশে রফতানিতে শুল্ক্কমুক্ত সুবিধা নেই, সেসব দেশের ক্রেতাদের শুল্ক্ক বাবদ একটা বড় খরচ করতে হয়। আবার বিশ্ববাজারে মেগা চেইন সপগুলোর নিজেদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতা আছে। ক্রেতা আকর্ষণে কম দামের পণ্য বিক্রি নিয়ে এ প্রতিযোগিতা। যেমন কোনো ক্রেতা ১ লাখ পিস পোশাক নিলে প্রথমে ২০ হাজার পিস বিক্রি করতে পারেন প্রাইস ট্যাগের দরে। পরের ২০ হাজার পিসে ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হচ্ছে। কিছু দিন পর আবার ২০ হাজার পিসে ২০ শতাংশ ছাড়। এভাবে এক পর্যায়ে একটা কিনলে আরেকটা ফ্রি ভিত্তিতে বিক্রি করা হয়। বিপণনে এই আগ্রাসী কৌশলের কারণে শেষ পর্যন্ত দরের চাপটা উৎপাদন পর্যায়ে এসে পড়ে।
মায়সিস গার্মেন্টের এমডি আশিকুর রহমান তুহিন জানান, ক্রেতারা কত দরে বিক্রি করছেন, সেটা বাংলাদেশের জন্য মুখ্য হওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশের স্বার্থ দর নিয়ে। ন্যায্য দর না বাড়িয়ে ক্রেতারা বিভিন্ন বিষয়ে চাপ দিয়ে যাচ্ছেন। এতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। যেমন একসময় ক্রয়-বিক্রয় ছাড়া আর কোনো সম্পর্ক ছিল না বিদেশি ক্রেতাদের সঙ্গে। এখন ক্রেতারা নিরাপদ পরিবেশের সঙ্গে শর্ত জুড়ে দিচ্ছেন। যেগুলো নানা রকম খরচের খাত তৈরি করছে। কারখানায় শ্রমিকদের বাচ্চার ডে-কেয়ারসহ শ্রমিকদের বিনোদন কেন্দ্র আছে কি-না, সেটাও তারা খুঁজে দেখছেন। এ কারণে প্রতি বছর উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। অথচ পোশাকের দর বাড়েনি। জানতে চাইলে টেক্সটাউন গার্মেন্টের এমডি এবং বিজিএমইএর পরিচালক আনোয়ার হোসেন সমকালকে বলেন, বছর শেষে কোনো বছর সামান্য মুনাফা থাকে। কোনো বছর লোকসান হয়। তার পরও শ্রমিকদের কথা চিন্তা করে কারখানা সচল রাখা হয়। কারখানা বন্ধ করতে হলে আইনি যে প্রক্রিয়া, সেটা অনেক ব্যয়বহুল। এ বিবেচনায় কারখানা চালু রাখতে হচ্ছে।
বিজিএমইএর গবেষণা সেল সূত্রে জানা গেছে, এমন অনেক পণ্য আছে, যেগুলোর দর গত তিন দশকে এক পয়সাও বাড়েনি। কোনো কোনো পণ্যের দর কমেছে। ৩০ বছর আগের ৩ ডলারের গোল গলা টি-শার্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এখনও সেই একই দরেই রফতানি হচ্ছে। অথচ এত বড় সময়ের ব্যবধানে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে কয়েকগুণ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেছেন, তৈরি পোশাকের সরবরাহ ব্যবস্থায় দুর্বলতা আছে। পশ্চিমা ক্রেতারা অন্যায্য বাণিজ্য করছেন। বাংলাদেশ থেকে ৫ ডলারের শার্ট নিয়ে ২৫ ডলারে বিক্রি করছেন। উৎপাদন আর ভোক্তা পর্যায়ে তফাৎ থাকছে ২০ ডলার। এই ২০ ডলারে হাত না দিয়ে ৫ ডলারের ওপর অত্যাচার করলে পোশাকশিল্প বেশি দূর এগোতে পারবে না। এই বাজার মডেলের বিষয়ে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজনের কথা বলেছেন তিনি।
তবে অধ্যাপক রেহমান সোবহানের এ বক্তব্যের সঙ্গে কিঞ্চিৎ দ্বিমত পোষণ করেছেন গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর। তার মতে, প্রতিযোগিতার বিশ্ববাজারে এটাই রুলস অব গেইম। ক্রেতারা বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকেও একই ব্যবসা কৌশলে পোশাক সংগ্রহ করছেন। অন্য দেশের উদ্যোক্তারা পারলে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা কেন পারবেন না। সক্ষমতা দিয়েই এখানে টিকে থাকতে হবে। তবে এ ধরনের ব্যবসা কৌশলের কারণে শেষ পর্যন্ত পোশাকের সাধারণ ভোক্তারা ঠকছেন বলে মনে করেন তিনি।
শ্রমিক নেতারা মনে করেন, পোশাক শিল্পে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূলত শ্রমিক এবং সাধারণ ভোক্তা। মধ্যস্বত্বভোগীরাই এ শিল্পের মুনাফা ভোগ করছে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন ইন্ডাস্ট্রিঅল গ্লোবাল কাউন্সিলের (আইজিসি) বাংলাদেশ শাখার সাধারণ সম্পাদক তৌহিদুর রহমান সমকালকে জানান, তারা জরিপে দেখেছেন নিম্ন আয়ের দেশে ৫ ডলারের উৎপাদিত একটি পোশাক সর্বোচ্চ ৭৫ ডলারেও বিক্রি করে ব্র্যান্ডগুলো। গত বছর ব্যাংককে অনুষ্ঠিত আইজিসির এক বৈঠকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। মাঝখানের অস্বাভাবিক এ পরিমাণ মুনাফা অর্থাৎ ক্রিমটা খাচ্ছে ব্র্যান্ড ও বায়িং হাউসগুলো। ওই বৈঠক থেকে পোশাকের দর বাড়ানোর অনুরোধ জানানো হয়েছিল। তার মতে, একটা পোশাক উৎপাদন শুরু হয় শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করে। আবার ভোক্তারা সে পোশাকটা প্রকৃত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। ব্র্যান্ডগুলো উৎপাদন পর্যায়ে ন্যায্যমূল্য না দেওয়ায় শ্রমিকরা ঠকছেন। ন্যায্য দর দিলে উদ্যোক্তারা শ্রমিকদের মজুরি বাড়াতে পারতেন।
ব্র্যান্ডের পক্ষে অতি মুনাফার বাণিজ্যের অভিযোগ মানতে নারাজ বায়িং হাউসগুলো। বায়িং হাউস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি কেআই হোসাইন সমকালক বলেন, উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় প্রাইস ট্যাগে দ্বিগুণ দর ধরা যেতেই পারে। কারণ ক্রেতাকে জাহাজ পরিবহন ব্যয়, ওয়্যারহাউস ব্যয়, আমদানিকারক দেশে নেওয়ার পর বিলি বণ্টন ব্যয়, ব্যবস্থাপনা ব্যয়- এত কিছুর পর মুনাফা করতে হয়। আবার যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ২১ শতাংশের মতো শুল্ক্ক দিতে হয়। অন্য অনেক দেশেই শুল্ক্ক দিয়ে পণ্য ছাড় করাতে হয়। ফলে ট্যাগের ৩ ডলারের পণ্য ৬ ডলারে বিক্রি করতে হয়। তবে উৎপাদন ব্যয় এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রির মধ্যে বড় ব্যবধান থাকলে সেটা অবশ্যই আপত্তিকর। এ বিষয়ে সমকালের পক্ষে ঢাকার কয়েকটি ব্র্যান্ড প্রতিনিধির বক্তব্য জানতে চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তারা কোনো কথা বলতে রাজি হননি।