ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে বেরিয়ে আসার (ব্রেক্সিট) সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই যুক্তরাজ্যের মুদ্রা পাউন্ডের অবমূল্যায়ন শুরু হয়। ফলে দেশটিতে পণ্য রফতানি বাবদ অর্জিত আয় কমে যায় বাংলাদেশের। বর্তমানে এ পরিস্থিতি কাটতে শুরু করেছে। মুদ্রাবাজারে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠছে পাউন্ডের বিনিময় হার, যার প্রভাবে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয়েও দেখা দিয়েছে ব্যাপক উল্লম্ফন। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) দেশটি থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ।
জানা গেছে, যুক্তরাজ্যে ব্রেক্সিটের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয় ২০১৭ সালের মার্চে। এর ফলশ্রুতিতে অবমূল্যায়ন ঘটে পাউন্ডের। সে সময় বাংলাদেশী মুদ্রায় পাউন্ডের বিনিময় হার ১২৮ টাকা থেকে নেমে আসে ৯৫ টাকায়। বর্তমানে সে পরিস্থিতি বদলেছে। আবার শক্তিশালী হয়ে উঠছে পাউন্ড। প্রতি পাউন্ডের বিপরীতে এখন পাওয়া যাচ্ছে ১২৮ টাকা করে, যার ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে।
রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে যুক্তরাজ্য থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয়েছে ২৩৪ কোটি ৫৭ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫৮ হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ২০০ কোটি ৪০ লাখ ৮৩ হাজার ডলারের সমপরিমাণ। এ হিসাব অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে পণ্য রফতানি বাবদ বাংলাদেশের আয় বেড়েছে প্রায় ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যমুখী রফতানি পণ্যের মধ্যে ওভেন ও নিট পোশাক, হোম টেক্সটাইল, কৃষিপণ্য, হিমায়িত মাছ, চামড়া-চামড়াজাত পণ্য ও ফুটওয়্যার, কাঁচাপাট ও পাটপণ্য এবং বাইসাইকেল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এসব পণ্যের রফতানিকারকরা বলছেন, ব্রেক্সিট সিদ্ধান্তের পরপরই পাউন্ডের ব্যাপক অবমূল্যায়ন ঘটে, যার প্রভাব দেখা গেছে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে। তবে মুদ্রাটি এখন বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাও ইতিবাচক, যার প্রভাব দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে।
লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি সায়ফুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ব্রেক্সিটের তেমন কোনো প্রভাব এখনো আমাদের ওপর পড়েনি। ইইউ সদস্য হিসেবে যুক্তরাজ্যে পণ্য রফতানিতে আমরা আগে যে সুবিধা পেতাম, তা অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন দেশটির বাণিজ্য প্রতিনিধিরা। দেশটির সরকারি প্রতিনিধিরাও জানিয়েছেন, ব্রেক্সিট কোনো বাণিজ্য বাধা হয়ে উঠবে না। আশা করছি, ভবিষ্যতেও এর কোনো প্রভাব পড়বে না।
রফতানি আয়ে উল্লম্ফন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্রেক্সিট সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার পরপরই পাউন্ডের অবমূল্যায়ন হয়। এতে দেশটির আমদানি খরচ বেড়ে যায়। এখন পাউন্ড শক্তিশালী হয়েছে, সেজন্য বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের রফতানি আয়েও ইতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনক, ফলে ফুটওয়্যার ও পোশাকের বাজারে চাহিদা প্রবৃদ্ধিও ভালো। সামগ্রিকভাবে এখন আশা করা যাচ্ছে, বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যে ব্রেক্সিটের কোনো প্রভাব পড়বে না এবং অব্যাহত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে ভবিষ্যতেও দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য আরো বাড়বে।
বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি মো. আমিন উল্লাহ বলেন, যুক্তরাজ্যের বাজারে হিমায়িত মাছ বিশেষ করে চিংড়ির রফতানি চাহিদা স্বাভাবিক রয়েছে। বর্তমানে দেশটির বাজার নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ দেখতে পাচ্ছি না।
যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশ থেকে রফতানি হওয়া অন্যতম প্রধান পণ্য পোশাক। চলতি বছর দেশটিতে পোশাক রফতানি বাবদ আয়ের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক। এ বিষয়ে বিজিএমইএর সংকলিত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি আয় বেড়েছে ২০ শতাংশ। চলতি বছর জুলাই থেকে ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যে পোশাক রফতানি বাবদ আয় হয়েছে ১৮৫ কোটি ১ লাখ ৮ হাজার ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৫৩ কোটি ২৯ লাখ ১০ হাজার ডলার।
বিষয়টি নিয়ে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ব্রেক্সিট সিদ্ধান্তের ফলে যুক্তরাজ্যের বাজার থেকে আমাদের প্রাপ্য মূল্যের পতন ঘটেছিল। এখন সে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। ফলে যুক্তরাজ্যের বাজার থেকে পোশাক পণ্যের রফতানি আয় বেড়েছে।
অন্যদিকে পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও রফতানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, গত দুই বছর আমরা ইউরোর দরপতন মোকাবেলা করেছি, এক পর্যায়ে পাউন্ডের দরপতনের প্রভাবও দেখতে পেয়েছি। বর্তমানে যুক্তরাজ্য থেকে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হওয়ায় ভবিষ্যতে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য আরো বাড়বে বলে আশা করছি।