Home Bangla Recent সংকট কাটিয়ে চামড়াশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে চায়

সংকট কাটিয়ে চামড়াশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে চায়

Leather sector needs soft loan to shift tanneries

হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারে স্থানান্তর করা হলেও কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার প্লান্ট (সিইপিটি) কার্যকর না থাকায় পিছিয়ে আছে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। গার্মেন্ট পণ্যের মতো বিশ্বে এই শিল্পেরও বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। জমির রেজিস্ট্রেশন না পাওয়া, পণ্য রপ্তানিতে বন্দরে অব্যবস্থাপনা, ব্যাংকঋণের অপর্যাপ্ততা ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে না ওঠায় সংকটেই ঘুরপাক খাচ্ছে এই শিল্প। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে এই শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব বলে মনে করছেন চামড়াশিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গবেষকরা।

গতকাল মঙ্গলবার কালের কণ্ঠ আয়োজিত ‘চামড়াজাত পণ্যের সম্ভাবনা ও করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন। আলোচনা অনুষ্ঠানের সহযোগিতায় ছিল ওরিয়ন ফুটওয়্যার লিমিটেড। অনুষ্ঠানে চামড়াশিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা এ শিল্পের  সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন।

বক্তারা বলেন, সরকার এই চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। কিন্তু ট্যানারিপল্লীতে জমির মূল্য পরিশোধ করার পরও এখনো রেজিস্ট্রেশন পাননি মালিকরা; যার জন্য উদ্যোক্তারা ব্যাংক থেকে ঋণও পাচ্ছেন না। মাঝপথে এসে আটকে আছে উৎপাদনও। কাঁচা চামড়া বিক্রেতারা ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে বকেয়া টাকা আদায় করতে না পেরে লোকসানে পড়েছেন। কষ্টেসৃষ্টে উৎপাদন সম্পন্ন করলেও চট্টগ্রাম বন্দরের অব্যবস্থাপনায় রপ্তানিতে প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছেন উদ্যোক্তরা। সিইটিপির উন্নয়নসহ বিদ্যমান সমস্যা ও সংকট সমাধানের মাধ্যমে এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে হবে।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান চামড়াশিল্পের বর্তমান সমস্যা সমাধানে সাধ্যমতো সহযোগিতার আশ্বাস দেন। এ শিল্পের বিদ্যমান সমস্যাগুলো সমাধান করা অসম্ভব নয় বলে মত দেন শিল্পসচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহ।

গোলটেবিল আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন কালের কণ্ঠ সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি বিদেশে গিয়ে একটি দোকানে বাংলাদেশের তৈরি জুতা দেখতে পাই। এটি আমাদের জন্য অনেক গর্বের একটি বিষয়।’ কালের কণ্ঠ’র নির্বাহী পরিচালক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘এই শিল্পে বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে। দেশের স্বার্থে এই সীমাবদ্ধতা দূর করে শিল্পটিকে এগিয়ে নিতে হবে। সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য আমাদের এই গোলটেবিল আয়োজন।’

অনুষ্ঠানে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এলএফএমইএবি) সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘বিশ্বের উৎপাদিত চামড়ার ৫  শতাংশ উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। কিন্তু চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবদান মাত্র ০.৫ শতাংশ। এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্যে বার্ষিক রপ্তানি ১২৩ কোটি ডলার।’ তিনি বলেন, ‘সিইটিপি কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের কোনো প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হলে চামড়াশিল্পের ৮০ শতাংশ সংকট দূর হয়ে যাবে।’ এ সময় তিনি চট্টগ্রাম বন্দরের আধুনিকায়নে একটি প্রতিযোগী কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, ‘ট্যানারি পল্লীর জমি রেজিস্ট্রেশন করে না দেওয়া পর্যন্ত আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছি না।’ বিপুল সম্ভাবনাময় এই খাতে ৪০ লাখ লোকের কর্মসংস্থান সম্ভব বলেও মনে করেন তিনি।

চামড়াশিল্পের সম্ভাবনার দিকগুলো তুলে ধরে ওরিয়ন ফুটওয়্যার লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন মোল্লা বলেন, ‘২০২১ সালের মধ্যে চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিদেশি দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি বাড়াতে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিতে পারে।’

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. শফিউল ইসলাম (মহিউদ্দিন) বলেন, ‘বাংলাদেশে চামড়াজাত পণ্যের ভালো বাজার রয়েছে বলেই বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো এখানে আসতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। তবে এ শিল্পের জন্য যে পথনকশার কথা হচ্ছে তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে যথাযথ সমন্বয়ের প্রয়োজন রয়েছে।’

সিইটিপি ব্যবস্থাপনায় কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে উল্লেখ করে যত দ্রুত সম্ভব এটা সম্পন্ন করতে অনুরোধ জানান বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প এখনো পরিপূর্ণভাবে স্থানান্তর হয়নি উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আফতাব আলী শেখ বলেন, ‘যত দ্রুত সম্ভব এটা করতে হবে।’ পাশাপাশি সাভারের ট্যানারি পল্লীর সিইটিপি কার্যকর না হওয়ায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটে বড় ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ হাইডস অ্যান্ড স্কিনস মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমরা অনেক ট্যানারি মালিককে কাঁচা চামড়া সরবরাহ করে এখন টাকা পাচ্ছি না। কিছু কিছু মালিকের কাছ থেকে বকেয়া টাকা আদৌ আদায় করা সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহের মধ্যে রয়েছি।’

বে-গ্রুপের চেয়ারম্যান শামসুর রহমান বলেন, ‘সিইটিপি কার্যকর না থাকায় বিশ্বের বড় বড় ক্রেতারা আমাদের পণ্য ক্রয় করতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে।’ তিনি চামড়াশিল্পের উন্নয়নে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে অর্থায়নেরও প্রস্তাব করেন।

এপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের সিনিয়র জিএম আতিকুল ইসলামও ট্যানারির বর্জ্য শোধনাগার প্লান্টের যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম দেশের চামড়াশিল্পের ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ে তোলার জন্য সামগ্রিক একটি লক্ষ্য দাঁড় করানোর পরামর্শ দেন। এ ছাড়া এ খাতে আরো বেশি সফল উদ্যোক্তা গড়ে ওঠা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে বেশির ভাগ বক্তাই চীনের চামড়ার বাজার হাতছাড়া হওয়াকে বাংলাদেশের চামড়াশিল্পের জন্য সম্ভাবনা বলে উল্লেখ করেন। তবে এই বাজার ধরতে এই শিল্পের প্রতি সরকারের আরো বেশি সুনজর আশা করেন বক্তারা।

বেঙ্গল লেদার কমপ্লেক্স লিমিটেডের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, ইউরোপের ক্রেতাদের সামগ্রিক ব্যয় কমে এসেছে। যে কারণে আমরা চাইলেও পণ্যের দাম বাড়াতে পারছি না।

এক্সপ্রেস লেদার প্রডাক্টস লিমিটেডের (লোটো বাংলাদেশ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জামিল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশে চামড়ার জুতার অনেক বড় বাজার রয়েছে। যে কারণে সম্প্রতি অ্যাডিডাস ও নাইকির মতো বড় বড় ব্র্যান্ড এই বাজারে খুচরা ব্যবসায় আগ্রহ প্রকাশ করছে। কিন্তু তারা এখানে কারখানা করতে আগ্রহী নয়।’

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, চামড়াশিল্পকে কেবল ব্যবসাবান্ধব হলে চলবে না, পরিবেশবান্ধবও হতে হবে। এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য যথাযথভাবে বিপণনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বক্তব্য দেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক নাজনীন আহমেদ।

কারগরি শিক্ষার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে এফবিসিসিআইয়ের প্রথম সহসভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, অটোমেশনের কারণে তৈরি পোশাক ও চামড়া খাত অগ্রসরমান শিল্প খাতে বিপুল পরিমাণ শ্রমিকের চাকরি হারানোর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তাই এখনই কারিগরি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়ায় উপযুক্ত সময় বলে মনে করেন তিনি। এটা করা না গেলে এই শিল্পকে সামনে শ্রমিক সংকটের কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে মনে করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন এলএফএমইএবির নির্বাহী পরিচালক বেগম কাজী রওশন আরা, ফারস্কিন লেদারটেকের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ ইজাবুল হক প্রমুখ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here