২০১৭ সালে জাপান সর্বমোট ১ হাজার ৩৬০ কোটি ডলারের বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক বহির্বিশ্ব থেকে আমদানি করেছে। জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, জাপানের মোট আমদানির মধ্যে তৈরি পোশাকের অবস্থান দশম। এর মধ্যে বাংলাদেশের হিস্যা ৭৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলার; যা জাপানের মোট পোশাক আমদানির মাত্র ৫.৪৭ শতাংশ। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা, গতানুগতিক বাজার না হওয়ায় সরকারি তরফে ৩ শতাংশ নগদ প্রণোদনা এবং বিশাল বাজার হিসেবে ভালো সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সম্প্রসারিত হচ্ছে না জাপানের তৈরি পোশাকের বাজার। বরং ২০১৬ সালের তুলনায় গত বছর বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩.৮৪ শতাংশ।
বিজিএমইএ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ১০ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবেই জাপানে রপ্তানি বেড়েছে। তবে সেটা জাপানের চাহিদার তুলনায় অনেক কম। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ২ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য জাপানে রপ্তানি হয়েছে। আর সর্বশেষ অর্থবছরে এই রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ কোটি ৪৪ লাখ ডলারের। এই ১০ বছরে রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ২৬ গুণ। তবে জাপানের তৈরি পোশাকের বিশাল বাজারে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশের হিস্যা একেবারেই নগণ্য। অথচ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে জাপানে।
গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, টানা প্রবৃদ্ধির মধ্যে গত বছর জাপানে পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির একটি মূল কারণ ২০১৬ সালে ঢাকার গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় নৃশংস হামলা। ওই হামলায় জাপানের একাধিক নাগরিক নিহতের ঘটনায় জাপানিদের বাংলাদেশে বিচরণের ওপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সে দেশের সরকার। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে।
ব্যবসায়ীরা জানান, ইউরোপ কিংবা আমেরিকার ক্রেতাদের তুলনায় জাপানি ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করা কষ্টকর। জাতি হিসেবে জাপানিরা অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। এ কারণে তৈরি পোশাকে তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করাও অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার। একজন ব্যবসায়ী জাপানি ক্রেতার সঙ্গে কাজ শুরুর অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ‘শুরুতেই জাপানের একটি বড় বায়ার আমার কারখানা পরিদর্শন করে কিছু সংস্কারের তালিকা ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া মাসে মাত্র ২ হাজার শার্টের কার্যাদেশ দেয়। শার্টের পরিমাণ দেখেই আমরা হতাশ হয়ে যাই; কিন্তু কেমন জানি জেদ অনুভব করলাম। ছয় মাস তাদের একজন প্রতিনিধি প্রতিটি শার্ট উত্পাদনের সব ধাপ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। পরে সন্তুষ্ট হয়ে তারা অর্ডারের পরিমাণ বাড়াতে থাকে। ৫ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে আমরা ওই বায়ারের বছরে ৬ মিলিয়ন শার্ট রপ্তানি করি।’
তিনি জানান, শুরুতে মানিয়ে নিতে একটু কষ্ট হলেও জাপানি ক্রেতারা ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতাদের তুলনায় কোনো অংশে কম কার্যাদেশ দেয় না। তা ছাড়া পোশাকের দরও ইউরোপের মতোই। এ ছাড়া একবার কোনো কম্পানিতে তাদের আস্থা সৃষ্টি হলে তারা সহজে কারখানা পরিবর্তন করে না।
তবে জাপানি ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যবসা শুরুর দিকের চ্যালেঞ্জ অনেকেই নিতে চায় না। এ কারণে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জাপানি বায়ারদের সঙ্গে কাজ করা কারখানার সংখ্যা এখনো হাতেগোনা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী জানান, ঝুঁকি নিয়ে হয়তো কোনো জাপানি ক্রেতার সঙ্গে কাজ শুরুর পর যদি কোনো কারণে তাঁর পছন্দ না হয় তাহলে তাঁরা বিনা নোটিশে কার্যাদেশ বাতিল করবে। এই ঝুঁকি নেওয়ার সামর্থ্য অনেকের নেই।
তবে এই ঝুঁকি নেওয়ার মধ্যেই যে ব্যবসায় সাফল্যের চাবিকাঠি তা জানিয়ে বিজিএমইএ পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সবাই ইউরোপ, আমেরিকার সহজ বাজারে ব্যবসা করতে চায়; কিন্তু অপ্রচলিত বাজার খোঁজার ঝুঁকি কেউ নিতে চায় না। যারা নিতে পারে তারা কিন্তু সাফল্যও পায়। জাপানিরা পণ্যের গুণগত মান নিয়ে অনেক বেশি সচেতন। এ কারণে তাদের সন্তুষ্ট করা অনেক কষ্টসাধ্য; কিন্তু চ্যালেঞ্জ নিয়ে তাদের পছন্দ, চাহিদা সম্পর্কে সচেতন হয়ে কাজ করতে পারলে এই বাজারে সাফল্যের সুযোগ অনেক বেশি।’ প্রসঙ্গত, সৈয়দ তানভীরের প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরেই জাপানের সবচেয়ে বড় রিটেইলশপ ‘ইউনিকলো’র সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে।
তবে চলতি অর্থবছর থেকেই জাপানের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অবস্থান সুদৃঢ় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ আবু তৈয়ব। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘জাপানিদের চাহিদা অনেক বেশি হাই কোয়ালিটি। তাদের কোয়ালিটির সঙ্গে তাল মেলানো কষ্টসাধ্য। তবে আশা করছি, এ বছর থেকে আমাদের দেশের কারখানাগুলো তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হবে। কারণ এখন আমাদের অধিকাংশ কারখানাই শতভাগ কমপ্লাইয়েন্সড। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের এই সার্টিফিকেট অন্য বায়ারদের কাছেও গ্রহণযোগ্য হবে। ফলে জাপানের অর্ডার পেতে এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা পাবে বাংলাদেশের পোশাক মালিকরা।’