২০১৩ সালের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসে নিহত শ্রমিকদের মরদেহ শনাক্ত করতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে সরকার। কেন্দ্রীয়ভাবে তথ্যভাণ্ডার না থাকায় নিহত শ্রমিকদের তথ্য দিতে পারেনি পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএও। এ ঘটনার পর ওই বছরের মে মাসে কেন্দ্রীয়ভাবে শ্রমিকদের বায়োমেট্রিক ডাটাবেজ বা তথ্যভাণ্ডার তৈরির ঘোষণা দেয় সংগঠনটি। এখন পর্যন্ত বিজিএমইএর কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন ২৮ লাখ শ্রমিক।
বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সংগঠনটির আওতাধীন সচল কারখানার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৩ হাজার। এখন পর্যন্ত ২ হাজার ২০০ কারখানা কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার কার্যক্রমের আওতায় এসেছে। এর মধ্যে ৩০০ কারখানা সংগঠনের বিগত পরিচালনা পর্ষদের সময়েই তথ্যভাণ্ডারে অন্তর্ভুক্ত হয়। বর্তমান পরিচালনা পর্ষদ দায়িত্ব নেয়ার পর নতুন করে তথ্যভাণ্ডারের কাজ শুরু করে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৯০০ কারখানাকে এর আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। নতুন করে চুক্তি হয়েছে তথ্যভাণ্ডার তৈরির প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও। তবে তাগাদা দেয়ার পরও সাড়া দিচ্ছিলেন না বেশকিছু কারখানার মালিকরা, যার পরিপ্রেক্ষিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে সব সেবা বন্ধের হুমকিও দেয়া হয় তাদের।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির বণিক বার্তাকে বলেন, বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার কার্যক্রমের মাধ্যমে পোশাক খাতের সক্রিয় কারখানা ও শ্রমিকসংক্রান্ত প্রকৃত তথ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে। পুরো কার্যক্রমটি শেষ হলে বিজিএমইএর আওতায় কতটি সচল কারখানা ও শ্রমিক আছে, তা সুনির্দিষ্ট করা সম্ভব হবে। আর এর মাধ্যমে শ্রমিকের সঠিক পরিচয় শনাক্তের মাধ্যমে বীমাসহ শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, যোগ্য কর্মকর্তার অভাবসহ তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থাপনায়ও ঘাটতি রয়েছে দেশের পোশাক কারখানা মালিকদের। আর এ কারণে তথ্যভাণ্ডারের আওতায় আসতে শুরুতে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন মালিকরা। একাধিকবার তাগাদার পর এখন পর্যায়ক্রমে ২ হাজার ২০০ কারখানা ইউনিটকে তথ্যভাণ্ডারের আওতায় নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে।
বিজিএমইএর তথ্যমতে, শ্রমিক সংখ্যার ভিত্তিতে মোট ৬টি ক্যাটাগরিতে বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডারের আওতায় আসছে সংগঠনের সদস্য পোশাক কারখানা ইউনিটগুলো। ১ থেকে ৫০০ শ্রমিক আছে এমন কারখানা ‘এ’ ক্যাটাগরি, ৫০১ থেকে ১ হাজার শ্রমিক আছে এমন কারখানা ‘বি’ ক্যাটাগরি, ১ হাজার ১ থেকে ২ হাজার ৫০০ শ্রমিক আছে এমন কারখানা ‘সি’ ক্যাটাগরি, ২ হাজার ৫০১ থেকে ৫ হাজার শ্রমিক আছে এমন কারখানা ‘ডি’ ক্যাটাগরি, ৫ হাজার ১ থেকে ১০ হাজার শ্রমিক আছে এমন কারখানা ‘ই’ ক্যাটাগরির এবং ১০ হাজার ১ জনের বেশি শ্রমিক আছে এমন কারখানা ‘এফ’ ক্যাটাগরির ইউনিট হিসেবে তথ্যভাণ্ডারের আওতায় আসছে। ক্যাটাগরিভেদে তথ্যভাণ্ডারের আওতায় কারখানা অন্তর্ভুক্ত করার ফিও ভিন্ন।
২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরের বছরের এপ্রিলে সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর শ্রমিকদের পূর্ণাঙ্গ তথ্যভাণ্ডার তৈরির বিষয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়। হতাহত শ্রমিকদের তথ্যবিভ্রান্তি দূর করতেই এ দাবি ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের জিএসপি সুবিধা ফিরে পাওয়ার অন্যতম শর্ত হিসেবে স্থান পায় তথ্যভাণ্ডারের বিষয়টি।
তবে গত দুই-তিন বছর কারখানার মানোন্নয়ন কার্যক্রমে বেশি ব্যস্ত ছিলেন মালিকরা। এখন এ ব্যস্ততা কিছুটা হলেও কমেছে। কমপ্লায়েন্স রক্ষণাবেক্ষণের স্বার্থেই মালিকরা এখন শ্রমিকের বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার তৈরির প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন। বিজিএমইএর পাশাপাশি নিট পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিকেএমইএরও তথ্যভাণ্ডারের কাজ চলছে। সেটি সম্পন্ন হলে দেশের পোশাক খাতের পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া সম্ভব হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে প্রতিটি কর্মচারী ও শ্রমিকের জীবনবৃত্তান্ত ও চাকরির তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে, যা প্রকৃত গার্মেন্ট শ্রমিকদের শনাক্তকরণ ও সর্বোপরি শ্রমিক-কর্মচারীদের জীবন বীমা প্রদানের ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। শ্রমিকের বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডারের মাধ্যমে কারখানা মালিকরা বিভিন্ন সুবিধা পাবেন। শ্রমিকদের বিষয়ে তথ্য কোনো দুর্ঘটনায় বিনষ্ট হলেও সার্ভার থেকে তা সংগ্রহ করা যাবে। শ্রমিকের ডিজিটাল সার্ভিস বুকের মাধ্যমে পুরো চাকরি জীবনের তথ্য সংগ্রহ করা যাবে। শ্রমিকের গ্রুপ বীমাসংক্রান্ত তথ্য অনলাইনে দেয়া সম্ভব হবে। এছাড়া প্রত্যেক শ্রমিকের একটি ইউনিক আইডিও এ প্রক্রিয়ায় তৈরি হচ্ছে।
এদিকে শ্রমিক প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ডাটাবেজের সুফল নিশ্চিত করার বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে মালিকদের ওপর। কারণ তথ্যভাণ্ডারের অপব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। একটি কারখানায় কোনো শ্রমিক কোনো প্রাপ্য দাবি-দাওয়া নিয়ে নিজস্ব অবস্থান প্রকাশ করলেই সেই শ্রমিককে চিহ্নিত করা হচ্ছে। আর অন্যান্য কারখানায় ওই শ্রমিক সম্পর্কে বিভিন্ন নেতিবাচক তথ্য-উপাত্ত দেয়া হচ্ছে। এতে করে সেই শ্রমিক আর কোথাও কাজ পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনি বলেন, ডাটাবেজের সুফল নিশ্চিত করার বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে মালিকদের ওপর। কারণ এর সুফল যেমন রয়েছে, তেমনি কুফলেরও মুখোমুখি হতে হচ্ছে শ্রমিককে। একবার কোনো শ্রমিকের কোনো নেতিবাচক তথ্য অন্তর্ভুক্ত হলে, সেই শ্রমিক অন্য কোনো কারখানায় কাজ পাচ্ছেন না।
তবে বিজিএমইএ প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এমন কোনো অভিযোগ এখন পর্যন্ত সংগঠনে আসেনি।