তাজরীন ফ্যাশনস ও রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সমালোচনার মুখে দেশের পোশাক শিল্প কারখানার মান তদারকিতে পরিদর্শন কার্যক্রমের উদ্যোগ নেয় সরকার। শ্রম আইনের আলোকে প্রণীত হয় কারখানা পরিদর্শনের নতুন কমপ্লায়েন্স মানদণ্ড। মানদণ্ডের এ কড়াকড়িতে প্রতি বছর কমছে এ-গ্রেডের পোশাক কারখানার সংখ্যা।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) ২০১৫, ২০১৬ ও ২০১৭ সালের পরিদর্শনে গ্রেড অনুযায়ী কারখানার সংখ্যার তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ-গ্রেডের পোশাক কারখানা কমছে। অন্যদিকে সি-গ্রেডের পোশাক কারখানা বাড়ছে।
ডিআইএফইর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৪৯৫টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনকৃত কারখানার মধ্যে এ-গ্রেডভুক্ত পোশাক কারখানা ছিল ৭৭৬টি বা ৩০ শতাংশ। বি-গ্রেডভুক্ত কারখানা ছিল ৮১২টি বা ৩২ শতাংশ এবং বাকি ৯৩৭টি বা ৩৭ শতাংশ ছিল সি-গ্রেডভুক্ত কারখানা।
২০১৬ সালের পরিদর্শনে এ-গ্রেডের কারখানা আরো কমে যায়। ওই বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ২ হাজার ৬৯টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়। এর মধ্যে এ-গ্রেডভুক্ত পোশাক কারখানা ছিল ৫৫১টি বা ২৭ শতাংশ, বি-গ্রেডভুক্ত কারখানা ছিল ৬৮৮টি বা ৩৩ শতাংশ এবং বাকি ৮৩০ বা ৪০ শতাংশ ছিল সি-গ্রেডভুক্ত কারখানা।
নতুন মানদণ্ডের ভিত্তিতে কমপ্লায়েন্স ইস্যু বাস্তবায়ন সংক্রান্ত ডিআইএফইর ২০১৭ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই বছর জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়ে পরিদর্শন করা হয়েছে মোট ১ হাজার ৭৭১টি পোশাক কারখানা। এর মধ্যে এ-গ্রেডভুক্ত কারখানা ছিল ৪৩৭ বা ২৪ শতাংশ, বি-গ্রেডভুক্ত কারখানা ছিল ২২৮টি বা ১৩ শতাংশ। বাকি ১ হাজার ১০৬ বা ৬২ শতাংশ ছিল সি-গ্রেডভুক্ত কারখানা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিআইএফই আইনের গুরুত্বপূর্ণ ধারার ভিত্তিতে তৈরি চেকলিস্ট (নজরদারির তালিকা) ব্যবহার করে কারখানা পরিদর্শন করে। আগে এ চেকলিস্টে প্রশ্ন ছিল ৫০টি। মানদণ্ডের ধরন ও নজরদারির বিষয়বস্তুতে পরিবর্তনসহ নতুন মানদণ্ডের চেকলিস্টে এখন প্রশ্ন রয়েছে ১২৫টি। ৭৫টি প্রশ্ন যুক্ত করার মাধ্যমে নজরদারির ব্যাপ্তি বেড়েছে পরিদর্শকদের, যার প্রভাব পড়েছে ক্যাটাগরি অনুযায়ী কারখানার সংখ্যায়।
২০১৭ সালের আগে ডিআইএফই কর্মচারীদের নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র প্রদান, মজুরি কাঠামো অনুসরণ হচ্ছে কিনা, পরিশোধ পরিস্থিতি কেমন— কমপ্লায়েন্সসংক্রান্ত এ ধরনের ২৬টি বিষয়ের সমন্বিত প্রকরণ বা ফরম্যাট বিবেচনায় কারখানাগুলোকে নম্বর দিত। প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে কারখানাগুলোকে এ, বি, সি— এ তিন গ্রেডভুক্ত করত সংস্থাটি। ৮৫ থেকে ১০০ নম্বরপ্রাপ্ত কারখানাকে ‘এ’, ৭০ থেকে ৮৪ নম্বর পাওয়া কারখানাগুলোকে ‘বি’ এবং ৭০-এর নিচে নম্বর পাওয়া কারখানাগুলোকে ‘সি’ গ্রেডভুক্ত করেছে অধিদপ্তর।
নতুন মানদণ্ডে ২০১৭ সাল থেকে ট্রেড ইউনিয়ন বিষয়টি বাদ দিয়ে ২৫টি বিষয়ের সমন্বিত ফরম্যাট বিবেচনায় কারখানাগুলোকে নম্বর দেয়া হচ্ছে। আর এ, বি, সি— এ তিন গ্রেডে পূর্ণ, আংশিক ও নগণ্য প্রতিপালনভেদে নম্বর দেয়ায় ভিন্নতা এনেছে ডিআইএফই। প্রাপ্ত নম্বরের এ তারতম্যের প্রভাব পড়েছে পরিদর্শন ফলাফলে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক মো. সামছুজ্জামান ভূইয়া বলেন, কারখানা পরিদর্শনের মানদণ্ডে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আইনের বিভিন্ন ধারার গুরুত্ব অনুযায়ী নাম্বারিং পদ্ধতিতেও এসেছে পরিবর্তন। সার্বিকভাবে আইন বাস্তবায়ন নজরদারির ব্যাপ্তি আগের চেয়ে বেড়েছে। পরিদর্শনের মানদণ্ড আগের তুলনায় সূক্ষ্ম হওয়ার ফলেই এ-গ্রেডের কারখানা কমেছে, সি-গ্রেডের বেড়েছে।
নতুন মানদণ্ডের ভিত্তিতে হওয়া পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আইনের ধারার গুরুত্ব বিবেচনায় বিধান বাস্তবায়ন নজরদারিতে মোট ৪ ধরনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে পোশাক কারখানায়। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ, গুরুত্বপূর্ণ ও সাধারণ— এ চার ধরনের প্রশ্নের উত্তরে প্রাপ্ত নম্বরের ভিত্তিতে কারখানার কমপ্লায়েন্স অবস্থা চিহ্নিত করা হয়েছে। সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে ১০টি, অতি গুরুত্বপূর্ণ ৫০, গুরুত্বপূর্ণ ৩৫ এবং সাধারণ ৩০টি। প্রশ্নের ধরন অনুযায়ী বিষয়ের গুরুত্ব, কর্মক্ষেত্রে বিষয়গুলোর অনুশীলন ও প্রায়োগিক বাস্তবতা, কমপ্লায়েন্সগত তাত্পর্য, সর্বোপরি আইন ও বিধিমালা, কনভেনশন এবং পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার ভিত্তিতে এ মানদণ্ড বিন্যাস করা হয়েছে।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ পরিদর্শন প্রশ্নের মাধ্যমে আইনের ধারা ৪ ও ৫ এবং বিধি-১৯-এর ১ ও ২৩ অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা তা যাছাই করা হয়েছে। এ আইন ও বিধি অনুযায়ী শ্রমিকের কাজের ধরন ও প্রকৃতির ভিত্তিতে শ্রমিকের পদবির শ্রেণীবিন্যাস করা হয়েছে কিনা এবং শ্রেণীবিন্যাস অনুযায়ী প্রয়োজনীয় তথ্যসহ নিয়োগপত্র দেয়া হয়েছে কিনা— এমন সব প্রশ্নের উত্তর ও প্রমাণ দিতে হয়েছে কারখানা কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া আইন অনুযায়ী নারী শ্রমিকের মাতৃত্বকালীন সুবিধা যথাযথভাবে পরিশোধসহ মাতৃকল্যাণ ছুটি দেয়া হয় কিনা, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য প্রশ্নের মধ্যে আছে— শ্রমিকের জন্য প্রত্যেক ফ্লোরে সুবিধাজনক স্থানে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পর্যাপ্ত খাবার পানির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে কিনা, প্রতিষ্ঠানের কোনো ভবন-অংশবিশেষ, চলাচলের পথ বা যন্ত্র জীবন ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিনা, ২০ জনের অধিকসংখ্যক ব্যক্তির কর্মসংস্থানযুক্ত কক্ষগুলোয় কমপক্ষে দুটি করে বহির্গমন পথ, চলাচলের পথ, সিঁড়ি ও মেঝেগুলো যথাযথভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রতিবন্ধকতামুক্ত রাখা হয় কিনা, প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্তসংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও সরঞ্জাম— হোজরিল নির্দিষ্ট পয়েন্টগুলোয় কার্যকরভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে কিনা, সব মেশিন ও সরঞ্জামের বিপজ্জনক অংশ এবং বৈদ্যুতিক জেনারেটর, মোটর বা রোটারি কনভার্টারের সব অংশ চলমান থাকা বা ব্যবহারের সময় দৃঢ়ভাবে নির্মিত নিরাপত্তামূলক বেষ্টনী দ্বারা রাখা হয়েছে কিনা, শ্রমিকের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা আইনে নির্ধারিত দৈনিক সর্বোচ্চ ৮ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার সীমা অতিক্রম করে কিনা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সরকার নির্ধারিত নিম্নতম মজুরির হার বাস্তবায়ন করা হয়েছে কিনা?
এদিকে এ-গ্রেডের কারখানার সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়ে ডিআইএফইর তথ্যের সঙ্গে একমত নন পোশাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারি সংস্থার এ তথ্যের সঙ্গে আমি একমত নই। বিষয়টি আরো খতিয়ে দেখে মন্তব্য করা সম্ভব হবে। অ্যাকর্ড-অ্যালায়েন্সের মূল্যায়ন কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে কারখানার অবস্থা আরো ভালো হচ্ছে। আবার এর স্বীকৃতিও পাওয়া যাচ্ছে। তাহলে কীভাবে এ-গ্রেডের কারখানা কমে আর সি গ্রেডের কারখানা বাড়ে?