সাভার এলাকার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন রহিমা। নিয়ম অনুযায়ী সপ্তাহে তার ৪৮ ঘণ্টা কাজ করার কথা। এর বেশি কাজ করলে আইন অনুযায়ী তার ঘণ্টাপ্রতি নির্ধারিত হারের দ্বিগুণ মজুরি পাওয়ার কথা। কিন্তু সারা বছর ধরেই সপ্তাহে গড়ে ৬০ ঘণ্টা করে কাজ করেন তিনি। কিন্তু এ অতিরিক্ত সময় কাজের জন্য প্রাপ্য মজুরিটাও তার ঠিকমতো মিলছে না।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান মাইক্রোফিন্যান্স অপরচুনিটিজ (এমএফও) প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে দেশের পোশাক শিল্প শ্রমিকদের প্রাপ্য ওভারটাইমের মজুরি না মেলার ঘটনা উঠে এসেছে। এক বছর ধরে দেশের পোশাক শিল্প অধ্যুষিত এলাকার শ্রমিকদের কাছ থেকে নিয়মিত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে এর ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দেশের পোশাক শিল্প শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা, মজুরি ও জীবন নির্বাহ-সংক্রান্ত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় বলা হয়, দেশের পোশাক শ্রমিকরা যত বেশি কাজ করেন, তাদের আয়ও তত কম হয়।
‘আ স্টাডি অব গার্মেন্ট ওয়ার্কার্স লাইভস অ্যান্ড ওয়েজেস ইন বাংলাদেশ, কম্বোডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া: দ্য বাংলাদেশী গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স ডায়েরি’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে চট্টগ্রামের বাইরের অন্যান্য অঞ্চলের শ্রমিকরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৬০ ঘণ্টা করে কাজ করেন। এসব শ্রমিক বছরের ৫৩ শতাংশ সময় আইনে বেঁধে দেয়া ৬০ ঘণ্টার সময়সীমার বাইরেও অতিরিক্ত কাজ করেন। এসব শ্রমিকের মোট উপার্জন ন্যূনতম মজুরির নিম্নতম হারের চেয়ে বেশি। কিন্তু শ্রমিকরা অতিরিক্ত সময় কাজ করার পর তাদের যে প্রাপ্য পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছেন না তারা। মজুরি পরিশোধের ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, অবৈধ অতিরিক্ত সময়ের জন্য প্রাপ্য মজুরি থেকে নিয়মিতভাবেই বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকরা।
এমএফওর নেতৃত্বে সিঅ্যান্ডএ ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বাংলাদেশ, ভারত ও কম্বোডিয়ার বিভিন্ন পোশাক কারখানার মোট ৫৪০ জন শ্রমিকের ওপর এ গবেষণা চালানো হয়। এর আগে বাংলাদেশে ব্র্যাক ও শ্রমিক অধিকার সংস্থা ফ্যাশন রেভ্যুলেশনের সহায়তায় ২০১৬ সালের মধ্যভাগ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যভাগ পর্যন্ত এক বছর মেয়াদি এক সমীক্ষার আওতায় শ্রমিকদের আয় ও ব্যয়ের পাশাপাশি জীবিকা এবং কাজের পরিবেশ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।
বাংলাদেশের শ্রমিকের কর্মঘণ্টার সঙ্গে অন্য তিন দেশের পোশাক শ্রমিকের আয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকরা প্রতি সপ্তাহে কাজ করেন ৬০ ঘণ্টার বেশি। এর পরও অতিরিক্ত এ কাজ বাবদ কম্বোডিয়া ও ভারতের সংশ্লিষ্ট খাতের শ্রমিকদের তুলনায় মজুরি কম পাচ্ছেন তারা। নির্ধারিত সময়সীমার অতিরিক্ত কাজ বেশি করলেও এ বাবদ ভারত ও কম্বোডিয়ার শ্রমিকদের তুলনায় এ বাবদ মজুরি কম পাচ্ছেন তারা। অন্যদিকে বাংলাদেশের শ্রমিকরা যত বেশি কাজ করছেন, তত কম আয় করছেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এমএফওর নির্বাহী পরিচালক গাই স্টুয়ার্ট গবেষণাটির পর্যালোচনায় বলেছেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা সবচেয়ে রূঢ় পরিস্থিতির মুখোমুখি হন এবং সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার হন। গড়ে শ্রমিকরা সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টা কাজ করেন এবং ঘণ্টাপ্রতি আয় করেন মাত্র ২৮ টাকা করে। ৬৪ শতাংশ ক্ষেত্রেই ঘণ্টাপ্রতি এ টাকার কম আয় করেন শ্রমিকরা। গবেষণায় প্রমাণ হয়েছে যে, শ্রমিকরা যত বেশি কাজ করেন, তত কম আয় করেন।
সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিক সপ্তাহে গড়ে ৬০ ঘণ্টা কাজ করেন। যদিও আইন অনুযায়ী সপ্তাহের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা ৪৮। ৪৮-৬০ ঘণ্টা পর্যন্ত বৈধ অতিরিক্ত সময়। আর ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করলেই তা অবৈধ। সমীক্ষায় দেখা গেছে, চট্টগ্রামের পোশাক শিল্প-কারখানাগুলোর শ্রমিকরা গড়ে ৫৬ ঘণ্টা কাজ করেন। আর চট্টগ্রামের বাইরের শ্রমিকরা করেন ৬৮ ঘণ্টা।
পোশাক শিল্পের কর্মঘণ্টা, আয় ও জীবনযাত্রার বাস্তবতার সঙ্গে গবেষণার ফলাফলের সামঞ্জস্য প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, গবেষণা প্রতিবেদনটি আমি দেখিনি। তবে শ্রমিকরা যে আইনি সীমার চেয়ে বেশি সময় কাজ করেন, এটা সঠিক। আর অতিরিক্ত সময় কাজ করে অনেক সময়ই তারা প্রাপ্য মজুরি পান না। স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেশি কাজ করলেও আয়ের পরিমাণ সে পরিমাণে বাড়ে না।
এদিকে পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধিরা এ গবেষণার ফলাফলের সঙ্গে একমত নন। তাদের দাবি শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় ওভারটাইম কাজ করতে আগ্রহী। আর কাজের চাপ থাকলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই অতিরিক্ত সময় কাজ করেন। আর অতিরিক্ত কাজের জন্য আইন অনুযায়ী তাদের প্রাপ্যও পরিশোধ করে দেয়া হয়। কারণ কাজের ন্যায্য মজুরি না পেলে শ্রমিক দিয়ে কাজ করানো সম্ভব হয় না।
পোশাক শিল্প মালিক প্রতিনিধি সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান বলেন, দ্বিগুণ মজুরির প্রত্যাশায় ওভারটাইমের প্রতি শ্রমিকদের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। শ্রমিকরা নিজেরাই অনেক সময় ওভারটাইম হিসেবে কাজ চান মালিকদের কাছে। এজন্য আইন অনুযায়ী তাদের প্রাপ্যও পরিশোধ করে দেয়া হয়। বেশি কাজ করে প্রাপ্য পাননি, এমন ঘটনা ঘটলে তা গোপন করা যায় না। কাজেই ‘শ্রমিকদের কাজ যত বেশি, আয় তত কম’— এমন তথ্য সঠিক নয় বলে আমি মনে করি।