বিশ শতকের শুরুর দিকে পূর্ববঙ্গের অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে দেয় পাট। দেশভাগের পর পাট ব্যবসায় দ্রুত পরিবর্তন আসে। পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলায় একের পর এক পাট শিল্প গড়ে উঠতে থাকে। নারায়ণগঞ্জের পাশাপাশি খুলনার খালিশপুর ও দৌলতপুর হয়ে ওঠে পাট শিল্পের অন্যতম কেন্দ্র। পাট চাষের পরিসর বৃদ্ধির পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও অন্যতম ক্ষেত্রে পরিণত হয় এসব পাটকল।
পাটের জন্য বিশেষ পরিচিতি পাওয়া সেই খুলনাই এখন এ শিল্পের ঊষর প্রান্তর। এ অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত নয়টি পাটকল লোকসান দিয়ে এখনো টিকে থাকলেও একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বেসরকারি পাটকল। খুলনায় বেসরকারি ২০টি পাটকলের মধ্যে সাতটিই এখন বন্ধ। সেকেলে হয়ে পড়েছে পাটকলের মেশিনারিজও। তার পরও পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে এখনো উঁচু অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ জুট মিল করপোরেশন (বিজেএমসি) ও ভারতের পাটকল অ্যাসোসিয়েশনের (আইজেএমএ) তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাটপণ্য থেকে বৈশ্বিক রফতানি আয়ের প্রায় ৬৫ শতাংশই রয়েছে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে, যেখানে এ খাতের রফতানি আয়ে ভারতের অংশীদারিত্ব ২৫ শতাংশের মতো। বাকি অংশ চীন, নেপাল ও পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের।
২০১৬-১৭ অর্থবছর পাটপণ্য রফতানি থেকে বাংলাদেশ আয় করে ৭৯ কোটি ডলার। একই সময়ে এ থেকে ভারতের আয় ছিল ৩২ কোটি ডলার। এর আগের অর্থবছরে (২০১৫-১৬) পাটপণ্য রফতানি থেকে দেশে এসেছিল ৭৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ভারতের আয় ছিল একই অর্থবছরে ২৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাটপণ্য রফতানি থেকে ভারতের ২৮ কোটি ডলার রফতানি আয়ের বিপরীতে বাংলাদেশে আসে ৭৫ কোটি ডলার। এর বাইরে কাঁচা পাটও রফতানি হয় বাংলাদেশ থেকে। যদিও দেশের সিংহভাগ পাটকলই ৫০ বছরের বেশি পুরনো মেশিন দিয়ে চলছে। পণ্যের বৈচিত্র্যও তুলনামূলক কম।
যদিও দক্ষতা বাড়িয়ে পাটপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে আরো ভালো অবস্থান তৈরির সুযোগ রয়েছে। রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের গবেষণা বলছে, ২০২২ সাল নাগাদ শুধু পাটের ব্যাগের বৈশ্বিক বাজার দাঁড়াবে ২৬০ কোটি ডলারের। ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিভিন্ন দেশে প্লাস্টিকের ব্যাগ নিষিদ্ধের কারণে এ বাজার তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ পাটপণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলোর সামনে এ বাজারে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে।
এ সুযোগ কাজে লাগাতে দেশের পাট শিল্পকে আরো উঁচুতে নেয়ার নানা উদ্যোগ চলছে বলে জানান বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফয়জুর রহমান চৌধুরী। বণিক বার্তাকে বলেন, বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদন করা হচ্ছে। পাট উৎপাদন বাড়াতেও কৃষককে প্রণোদনা ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। পাটপণ্য উৎপাদনে সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছে বেসরকারি খাতও। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠান বিজেএমসিকে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে স্বচ্ছভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রথমবারের মতো বেলভিত্তিক পাট ক্রয় ও ডিজিটাল ক্রয় ব্যবস্থাপনা চালু হয়েছে। ব্যয় হ্রাসের লক্ষ্যে পাট ক্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা ১৮০ থেকে ৭৩-এ নামিয়ে আনা হয়েছে। এজন্য গত অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১৭০ কোটি টাকা কমানো সম্ভব হয়েছে। বিজেএমসির নিয়ন্ত্রণাধীন বন্ধ পাটকল চালু, পাটকলগুলোর আধুনিকায়নে (বিএমআরই) পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী হস্তান্তরের চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করায় ও উৎপাদন বন্ধ রাখায় আটটি পাটকল পুনঃগ্রহণ করা হয়েছে।
এসব উদ্যোগের ফলে দেশে পাটপণ্যের উৎপাদন আবার বাড়তে শুরু করেছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে বিভিন্ন ধরনের পাটপণ্য উৎপাদন হয় ১৩ লাখ ৫১ হাজার টন। পরের অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ লাখ ৬০ হাজার টনে। গত অর্থবছর উৎপাদন আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১৫ লাখ ৩০ হাজার টনে। অন্যদিকে ভারতে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে পাটপণ্যের উৎপাদন ছিল ১২ লাখ ৯৬ হাজার টন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশটিতে এর উৎপাদন ছিল ১১ লাখ ৭০ হাজার ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৬ লাখ ৫৬ হাজার টন।
বাংলাদেশে উৎপাদিত পাটজাত সুতার সবচেয়ে বড় বাজার তুরস্ক। এর পরই রয়েছে চীন, ভারত, মিসর, ইরান, বেলজিয়াম, রাশিয়া, পাকিস্তান ও মেক্সিকো। পাটের অন্যান্য পণ্য সবচেয়ে বেশি রফতানি হয় সুদান, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কেনিয়া, বেলজিয়াম ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
পাটপণ্যের বহুমুখীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার (জেডিপিসি)। এরই মধ্যে ২৩৫ ধরনের দৃষ্টিনন্দন বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনও হচ্ছে। এছাড়া পাট থেকে পলিথিনের বিকল্প ‘সোনালি ব্যাগ’, ভিসকস, কম্পোজিট জুট টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস, চারকোল, পাট পাতার পানীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পাট শিল্পের নতুন দিগন্ত উন্মোচনে কাজ করছে। ‘পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন, ২০১০’-এর আওতায় ১৭টি পণ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ বাজারে পাটের বস্তার চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে বছরে প্রায় ১০০ কোটি পিস। বিশেষ অভিযান পরিচালনার ফলে আইনটি প্রায় শতভাগ বাস্তবায়ন হয়েছে। পাটপণ্যকে উৎসাহিত করতে ৬ মার্চ জাতীয় পাট দিবস হিসেবে পালন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জুট ডাইভারসিফায়েড প্রডাক্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রিয়েশন প্রাইভেট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করীম মুন্না বণিক বার্তাকে বলেন, বহুমুখী পণ্য উৎপাদনের কারণে পাটের সম্ভাবনা অফুরন্ত। সারা বিশ্ব এখন সবুজায়নে জোর দিচ্ছে। ইইউভুক্ত দেশগুলো পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ওই দেশগুলোয় বিপুল পরিমাণ পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টি হবে। এছাড়া পাটের শপিং ব্যাগ ও শৌখিন দ্রব্যেরও চাহিদা রয়েছে। এ বাজার ধরতে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কারখানা স্থাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে গবেষণার পাশাপাশি তৈরি করতে হবে দক্ষ জনবল।