Home Bangla Recent ভালো নেই গ্রিন কারখানার উদ্যোক্তারা

ভালো নেই গ্রিন কারখানার উদ্যোক্তারা

ঢাকার অদূরে ধামরাইয়ে ৩৯ বিঘা জমির ওপর পরিবেশবান্ধব গ্রিন কারখানা স্থাপন করেছে একেএইচ ইকো অ্যাপারেলস। ৪ লাখ ৮০ হাজার বর্গফুটের কারখানাটিতে রয়েছে শ্রমিকদের জন্য আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা। পরিবেশবান্ধব হওয়ায় কারখানাটির কার্বন নিঃসরণ কম। পানি-বিদ্যুতের দক্ষ ব্যবহার করে পরিচালিত হচ্ছে কারখানাটি। তবে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। কোম্পানির প্রচলিত কারখানায় যে মুনাফা, গ্রিন কারখানায় হচ্ছে তার ১০ ভাগের ১ ভাগ।

একেএইচ ইকো অ্যাপারেলসের মতো দেশের পরিবেশবান্ধব আরেকটি কারখানা প্লামি ফ্যাশনস। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের উত্তর নরসিংপুরে সাড়ে পাঁচ একর জমির ওপর প্ল্যামি ফ্যাশনসের এ কারখানা। বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব নিট পোশাক কারখানার স্বীকৃতিও প্লামি ফ্যাশনসের। যদিও প্রত্যাশা অনুযায়ী ব্যবসা করতে না পারার কথা বলছে প্লামি ফ্যাশনস কর্তৃপক্ষও।

প্লামি ফ্যাশনসের উদ্যোক্তা ফজলুল হক। নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক এ সভাপতি বলেন, আমরা একটি খারাপ সময়ে পরিবেশবান্ধব গ্রিন কারখানা গড়ে তোলা শুরু করেছি। আমার একার কথা বলছি না, সবারই প্রত্যাশা ছিল বড়। কারখানাগুলো ব্যবসা একেবারে খারাপ করছে বলব না, তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী হচ্ছে না। এর একটি বড় কারণ বৈশ্বিক বাজারের শ্লথগতি। সার্বিকভাবে বাজারের অবস্থা খারাপ থাকলে গ্রিন হোক আর যা-ই হোক, ব্যবসা ভালো হওয়ার কথা নয়।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যমতে, সর্বোচ্চ পরিবেশবান্ধব হিসেবে লিড প্লাটিনাম স্বীকৃতি পেয়েছে মোট ১৩টি কারখানা। আরো ৬৭টি কারখানা এ স্বীকৃতির অপেক্ষায় আছে। গ্রিন হিসেবে গড়ে উঠছে আরো ২০০টির মতো কারখানা। একেএইচ ইকো অ্যাপারেলস ও প্লামি ফ্যাশনসের মতোই বাকি গ্রিন কারখানার উদ্যোক্তারাও বলছেন, ব্যবসার প্রবৃদ্ধি বিবেচনায় পরিবেশবান্ধব স্বীকৃতি কাজে আসছে না। ব্যবসায় ভালো করতে পারছে না বেশির ভাগ গ্রিন কারখানা।

গ্রিন কারখানায় বিনিয়োগের সময় ক্রেতাদের কাছ থেকে পণ্যের ভালো দাম পাওয়ার আশা করেছিলেন উদ্যোক্তারা। গ্রিন কারখানা স্থাপনের পর স্বীকৃতি আদায়ে তাদেরকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে, রিটার্নটা সে অনুপাতে হচ্ছে না। তাই শুধু মুনাফার অংক বিবেচনায় নিয়ে যারা গ্রিন উদ্যোগ নিয়েছেন, তাদের হতাশ হতে হচ্ছে।

একেএইচ গ্রুপের ডিএমডি আবুল কাশেম বলেন, গ্রিন কারখানার যেসব মানদণ্ড, তার সবই আমরা পূরণ করেছি। কিন্তু ক্রেতারা পণ্যের মূল্য দিচ্ছেন না। দু-তিন বছর ধরে ব্যবসা নেই বললেই চলে। গ্রিন কারখানা করে  অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ আমাদের হয়নি। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার আগে একেএইচ গ্রুপ ১০ কোটি টাকা মুনাফা করলেও এখন করছে ১ কোটি টাকা।

গ্রিন কারখানার উদ্যোক্তারা বলছেন, একটি সাধারণ কারখানা করতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন হয়, গ্রিন কারখানায় তার চেয়ে ১৫-২০ শতাংশ বেশি করতে হচ্ছে। অতিরিক্ত এ বিনিয়োগের রিটার্ন পেতে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়তি ক্রয়াদেশ প্রয়োজন। সেই সঙ্গে ব্যাংকঋণের যৌক্তিক সুদহার ও কর সুবিধাও প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু তা না হওয়ায় গ্রিন কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ ধরে রাখতে সরকারি প্রণোদনার বিকল্প নেই।

গ্রিন কারখানা স্থাপনের প্রক্রিয়ায় আছে ওয়েল গ্রুপ। গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক নুরুল ইসলাম বলেন, রাতারাতি কেউ গ্রিন কারখানা করতে চাইলে তাকে নিরুৎসাহিত করা উচিত। বরং ধাপে ধাপে কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন। কারণ আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলোর গ্রিন কারখানা নেই। তারা এখন কম মূল্যে পণ্য সরবরাহ করছে। ক্রেতারাও তাদের পেছনে ছুটছে। আর আমাদের গ্রিন কারখানার উদ্যোক্তাদের ক্রেতারা শুধু বাহবা দিচ্ছে।

গ্রিন কারখানা করেও ক্রেতাদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করতে না পারার জন্য মালিকদের ব্যর্থতাকেও দায়ী করছেন শিল্প বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, ক্রেতারা কম দামে পণ্য কিনতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। পণ্যের মূল্য নিয়ে সমঝোতায় মালিকদের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে। দরকষাকষির দক্ষতা কাজে লাগাতে না পারায় এই মুহূর্তে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা পাচ্ছেন না উদ্যোক্তারা। তবে দীর্ঘমেয়াদে এ বিনিয়োগের সুফল আসবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্বল্পমেয়াদে না হলেও দীর্ঘমেয়াদে এ বিনিয়োগের সুফল পাওয়া যাবে। গ্রিন হওয়ার পরও হয়তো ভালো মূল্য বা বেশি ক্রয়াদেশ আসছে না। কিন্তু এ কারখানাই ভবিষ্যতে ভালো ব্যবসা দেবে উদ্যোক্তাদের। তাত্ক্ষণিক হতাশা থেকে কোনো শিল্পোদ্যোক্তার নিরুৎসাহিত হলে চলবে না। কারণ গ্রিন না হলে তাদের ভবিষ্যৎ ভালো হবে না।

এখন পর্যন্ত লিড গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে ১৩টি কারখানা। কারখানাগুলো হলো— রেমি হোল্ডিংস, তারাসিমা অ্যাপারেলস, প্লামি ফ্যাশনস, ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও, কলাম্বিয়া ওয়াশিং প্লান্ট, ইকোটেক্স, এসকিউ সেলসিয়াস ইউনিট-২, কানিজ ফ্যাশনস, জেনেসিস ওয়াশিং, জেনেসিস ফ্যাশনস, এসকিউ বিরিকিনা, এসকিউ কোলব্লাংক ও এনভয় টেক্সটাইলস লিমিটেড। এসব গ্রিন কারখানা গড়ে তুলতে ব্যাংকঋণের শরণাপন্ন হয়েছেন উদ্যোক্তারা। গ্রিন কারখানাগুলোর ব্যবসা যে ভালো যাচ্ছে না, তা বলছেন ব্যাংকাররাও।

গ্রিন কারখানা স্থাপনে বিনিয়োগ আছে, এমন একটি ব্যাংকের একজন শীর্ষ নির্বাহী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অনেকগুলো প্রকল্পেই ব্যাংক দেনা বেড়েছে। দেনা বেড়ে যাওয়া ব্যবসা ভালো না হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।

একাধিক গ্রিন কারখানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতানুগতিক পদ্ধতির একটি কারখানাকে সক্ষমতা অনুযায়ী এক লাখ পিস টি-শার্টের ক্রয়াদেশ ধরতে অনেক বেগ পেতে হতো। একই সক্ষমতার একটি গ্রিন কারখানা ওই পরিমাণ ক্রয়াদেশ নিশ্চিত করতে পারছে। তবে পণ্যের বাড়তি কোনো মূল্য পাচ্ছে না। আবার চাহিদা কম থাকায় অতিরিক্ত ক্রয়াদেশও ধরা সম্ভব হচ্ছে না।

তার পরও খাতটিকে টেকসই করতে এ ধরনের কারখানা স্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে বলে মনে করেন বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান। তিনি বলেন, গ্রিন কারখানাগুলো ব্যবসা ভালো করছে বলব না, কারণ বৈশ্বিক বাজারেই এখন চাহিদা কম। একেবারেই ব্যবসা করছে না এটা বলা যাবে না। তবে বিনিয়োগ অনুযায়ী হচ্ছে না। গ্রিন কারখানাগুলো যে সুনাম অর্জন করছে, ভবিষ্যৎ ব্যবসায় তা কাজে লাগবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here