Home Bangla Recent সিইটিপি নির্মাণ বিলম্বে হুঁশিয়ারি

সিইটিপি নির্মাণ বিলম্বে হুঁশিয়ারি

সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণে কাজ পাওয়া চীনা ঠিকাদারকে কঠোর বার্তা দিল সরকার। আগামী ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে সিইটিপি নির্মাণের কাজ শেষ করতে জিয়াংসু লিংজাই এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন কম্পানি লিমিটেড ও ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে সময় বেঁধে দিল শিল্প মন্ত্রণালয়। সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, এবারই শেষ। এরপর আর সময় বাড়ানো হবে না। ঈদুল আজহার আগেই কাজ শেষ করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে চীনা ঠিকাদারকে। বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে না পারলে জরিমানার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সিইটিপি নির্মাণে সাতবার মেয়াদ বাড়িয়েছে যৌথভাবে কাজ করা দুটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান।

জানতে চাইলে সাভার চামড়াশিল্প প্রকল্পের পরিচালক (উপসচিব) জিয়াউল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণে ঠিকাদার আরো কিছু সময় চেয়েছে। আদালতের নির্দেশে তারা একটি প্রতিবেদনও দাখিল করেছে। সেখানে তারা সময় বাড়ানোর আবেদন জানিয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে তাদের জুলাই পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।’

সাভার চামড়া শিল্পনগরী প্রকল্পের ওপর গত ১৮ জানুয়ারি এক আন্ত মন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) চেয়ারম্যান মুশতাক হাসান মোহাম্মদ ইফতিখারের সভাপতিত্বে বিসিকের বোর্ড সভায় অনুষ্ঠিত বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরামর্শকসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, আগামী পাঁচ মাসের মধ্যে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার নির্মাণের কাজ শেষ করতে হবে। এ সময় চীনা ঠিকাদারকে কঠোরভাবে নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। চীনা ঠিকাদারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে প্রয়োজনে বাংলাদেশে চীনা দূতাবাস কিংবা চীনা সরকারের হস্তক্ষেপ চাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে বৈঠকে। প্রকল্প পরিচালক জিয়াউল হককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে উপস্থিত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

বৈঠকে উপস্থিত ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদসহ অন্য নেতারা জানিয়েছেন, চীনা ঠিকাদার যদি ২৮ জুলাইয়ের মধ্যে সিইটিপি চালু করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে চামড়াশিল্পে ধস নামবে। সাভারে যাওয়া চামড়া শিল্পমালিকরা চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। চামড়াশিল্পের এক নেতা বৈঠকে জানিয়েছেন, সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে কারখানা নির্মাণে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়ে গেছে। বিএফএলএলএফইএ-এর সভাপতি বৈঠকে চীনা ঠিকাদারের ওপর নিজের বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘এখন নতুন করে ঠিকাদার নিয়োগ করলে অনেক সময় অপচয় হবে। তার চেয়ে চীনা ঠিকাদার দিয়েই কাজটি শেষ করা উচিত হবে। সে ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তরের উচিত হবে ঠিকাদার যখনই অপরিশোধিত পানি নদীতে ফেলবে, তখনই ঠিকাদারকে জরিমানা করতে হবে।’ শাহীন আহমেদও একই মত পোষণ করেন।

এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, হাজারীবাগে চামড়া শিল্পনগরীর বিভিন্ন কারখানার তরল বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গায় পড়ায় নদীর যে বেহাল দশা হয়েছিল, একই পরিণতির দিকে যাচ্ছে ধলেশ্বরী। নির্ধারিত সময়ে সিইটিপি নির্মাণের কাজ শেষ না হওয়ায় কারখানার ভেতর থেকে কোনো ধরনের শোধন করা ছাড়াই তরল ও কঠিন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। ময়লা-আবর্জনার পাশাপাশি পচা চামড়ার দুর্গন্ধের কারণে দুঃসহ হয়ে উঠেছে স্থানীয়দের জনজীবন। নদীতে আগের মতো মাছ ধরা পড়ছে না বলেও জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। যদিও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন দাবি করেছেন, ধলেশ্বরী নদীতে ধীরে ধীরে দূষণের মাত্রা কমে আসছে।

১৮ জানুয়ারির বৈঠকে বিসিকের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য বলছে, সিইটিপির জন্য চারটি মডিউলের পুরোপুরি কাজ এখনো শেষ হয়নি। দুুটি মডিউলের এসএস রেইলসহ ব্লোয়ার রুমের দরজা-জানালার কাজ শেষ হয়নি। বর্তমানে তিনটি মডিউলের এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট চলছে। চারটি মডিউলের প্রোপেলার, বটম এরেটর, সারফেস এরেটর, ডিফিউজার মোটরসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এখনই কাজ করছে না বলে অভিযোগ তুলেছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। ওই সব যন্ত্রাংশ মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে নষ্ট হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও মরিচাও পড়েছে। জিয়াংসু লিংজাই এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন কম্পানি লিমিটেড ও ডেভেলপমেন্ট কনস্ট্রাকশন লিমিটেডকে স্লার্জ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস) এর নকশা করার কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত নকশা চূড়ান্ত হয়নি বলেও জানিয়েছেন বিসিকের কর্মকর্তারা। সিইটিপি নির্মাণের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ আমদানিতে এলসি খুলতে দ্রুত করণীয় ঠিক করতে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের ঢাকা গবেষণাগার তাদের নিয়মিত নজরদারির অংশ হিসেবে কয়েক দফায় সিইটিপির আউটলেট, ডাম্পিং ইয়ার্ড এবং নদীর জোয়ার-ভাটার সময় নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে তরল বর্জ্য ও পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে দেখেছে যে সিইটিপি থেকে ধলেশ্বরী নদীতে নির্গত তরল বর্জ্যের গুণগতমানে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন আসেনি। বরং দিন দিন তা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। কঠিন বর্জ্যের উন্মুক্ত ডাম্পিং, সিইটিপি থেকে বাইপাস, লবণ এবং ক্রোম পৃথকীকরণ কার্যকর না হওয়ায় নদীর পানিতে জলজ জীবের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর লবণ এবং ক্রোমিয়াম কয়েক গুণ বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, পানির তাপমাত্রা, ক্ষারের পরিমাণ, দ্রবীভূত অক্সিজেন কম থাকা, বিদ্যুৎ পরিবহন, ক্রোমিয়ামের পরিমাণ, লবণের পরিমাণ, জৈব রাসায়নিক উপাদানের মানমাত্রা ১৯৯৭-এর অনুমোদিত মানমাত্রার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এবং সরাসরি নদী ও তত্সংলগ্ন এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সাতবার সময় বাড়ানোর পরও এক হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগারের (সিইটিপি) নির্মাণকাজ শেষ করতে পারেনি চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কারখানার ভেতর থেকে কোনো ধরনের শোধন করা ছাড়াই প্রকাশ্যে অপরিশোধিত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে ধলেশ্বরী নদীতে। ধলেশ্বরী নদীতে প্রতিদিন কারখানার শ্রমিকদের পাশাপাশি এলাকার মানুষও গোসল করছে। শিল্পনগরী এলাকায় চামড়ায় ব্যবহার করা লবণ পরিশোধনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। যার ফলে পরিশোধন ছাড়াই লবণাক্ত পানি গিয়ে পড়ছে ধলেশ্বরী নদীতে। লবণাক্ত পানি নদীতে পড়ায় বিভিন্ন জাতের মাছ মরে যাচ্ছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here